দুই কিশোরকে প্রকাশ্যে মারধর করে তাদের মায়েদের ‘নাকে খত’ দেওয়ালেন বিএনপি নেতা

Bangla Post Desk
বাংলা পোস্ট প্রতিবেদক
প্রকাশিত:০৪ মে ২০২৫, ০৮:২৫ পিএম
দুই কিশোরকে প্রকাশ্যে মারধর করে তাদের মায়েদের ‘নাকে খত’ দেওয়ালেন বিএনপি নেতা

ফেনী সদর উপজেলার পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের মাথিয়ারা গ্রামে হাঁস ও কবুতর চুরির অভিযোগ তুলে দুই কিশোরকে প্রকাশ্যে মারধর করা হয়েছে। একইসঙ্গে তাদের মায়েদের ‘নাকে খত’ দিয়ে জনসম্মুখে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা হয়।

রবিবার (৪ মে) এ নির্যাতনের ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে সমালোচনা শুরু হয়।

গত বৃহস্পতিবার (১ মে) রাতে ইউনিয়নের ‘খালুর দোকান’ এলাকায় সালিশ বৈঠকে এ ঘটনা ঘটে। এতে প্রধান সালিশদার ছিলেন ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ও সাবেক চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন দেলু।

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, দেলোয়ার হোসেন লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছেন এবং দুই কিশোরের মা খত দিয়ে ক্ষমা চাইছেন। অপরপাশে কিশোরদের লাঠি দিয়ে মারধর করা হচ্ছে।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কয়েকদিন আগে মাথিয়ারা গ্রামের জাহাঙ্গীর আলমের বাড়ি থেকে হাঁস ও কবুতর চুরির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় একই গ্রামের দুই কিশোরকে সন্দেহ করা হয়। গত বৃহস্পতিবার বিকালে দুই কিশোরকে আটক করে মারধর করা হয়। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ও সাবেক চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন। রাতে তাদের বিরুদ্ধে সালিশ বৈঠক ডাকা হয়। সেই বৈঠকে দুই কিশোরের মায়েদের ডেকে আনা হয়। স্থানীয় কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার উপস্থিতিতে তাদের আবারও মারধর করা হয়। এরপর তাদের মায়েদের বলা হয়, সন্তানদের সঠিকভাবে গড়ে তুলতে না পারার দায়ে জনসম্মুখে ক্ষমা চাইতে হবে। নাকে খত দিয়ে সবার সামনে ক্ষমা চাইতে হবে।

ওই এলাকার সাবেক ইউপি সদস্য নুরনবী বলেন, ‌‘চুরির ঘটনায় এলাকার মানুষজন ওই দুই কিশোরের ওপর ক্ষুব্ধ ছিল। তাদের মাকেও মারধর করতে চেয়েছিল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে দেলু চেয়ারম্যানসহ আমরা তাদের মাকে রক্ষা করতে নাকে খত দিয়ে কিশোরদের মায়ের জিম্মায় ছেড়ে দিয়েছি।’

নির্যাতনের শিকার এক কিশোরের মা বলেন, ‘আমার ছেলে যদি ভুল করে থাকে, তার বিচার হতে পারে। কিন্তু আমাকে সবার সামনে এভাবে অপমান করা হবে, তা কল্পনাও করিনি।’

আরেক কিশোরের মা বলেন, ‘আমি কোনও অন্যায় করিনি। সন্তানের বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ তুলে শুধু মা হওয়ার কারণে আমাকে এত বড় অপমান সহ্য করতে হলো।’

এ বিষয়ে প্রধান সালিশদার বিএনপি নেতা দেলোয়ার হোসেন দেলু বলেন, ‘আমি কাউকে মারধর করিনি। অভিযুক্ত কিশোরদের মায়েরা আমাদের কাছে আবদার করেছিলেন—বিষয়টি যেন সামাজিকভাবে মীমাংসা করা হয়। তারাই স্বেচ্ছায় নাকে খত দিয়েছেন। আমি কাউকে বাধ্য করিনি। মূলত জনরোষ থেকে তাদের প্রাণ রক্ষা করার জন্য এমন সিদ্ধান্ত দিতে বাধ্য হয়েছিলাম।’

ফেনী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ সামছুজ্জামান বলেন, ‘ভিডিওটি নজরে এসেছে আমাদের। পুলিশ ঘটনাস্থলে গেছে। চুরির অভিযোগ থাকলেও নাকে খত দেওয়ার মতো ঘটনা অন্যায় আচরণ। বিষয়টি তদন্ত করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এদিকে, এ ঘটনায় প্রশাসন ও মানবাধিকারকর্মীরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুলতানা নাসরীন কান্তা বলেন, ‘নারীকে এভাবে হেনস্তা করার অধিকার কারও নেই। কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারে না। আমরা বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো।’

ফেনীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মো. আরিফুল ইসলাম সিদ্দিকী বলেন, ‘ভিডিওটি আমার নজরে এসেছে। তদন্ত শুরু হয়েছে। কেউ অভিযোগ করলে সেটিও গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে।’

মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, কিশোরদের শারীরিকভাবে নির্যাতন এবং তাদের মায়েদের অপমান করা আইনের লঙ্ঘন। তারা এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।

স্থানীয় বাসিন্দা রিয়াজ উদ্দিন বলেন, ‘শুধুমাত্র দেলু চেয়ারম্যান নয় সালিশে আরও কিছু মানুষরূপী লোক ছিল, তাদেরও শাস্তি হওয়া উচিত।’

এমন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দেলোয়ার হোসেনের বিএনপির সব পর্যায়ের পদ স্থগিত করেছে জেলা বিএনপি। জেলা বিএনপির সদস্যসচিব আলাল উদ্দিন আলাল বলেন, ‘বিষয়টি কেন্দ্রীয় দফতরের নির্দেশে তদন্ত করছি আমি। সোমবারের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিয়ে দলের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতিমধ্যে দেলোয়ার হোসেনের বিএনপির সব পর্যায়ের পদ স্থগিত করা হয়েছে।’