বের্নাবেউতে এবার রিয়ালকে গুঁড়িয়ে দিল মিলান
গত সপ্তাহে এল ক্লাসিকোতে ঘরের মাঠে বার্সেলোনার কাছে ৪-০ গোলে হেরে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ম্যাচে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয়ে মাঠে নেমেছিল রিয়াল মাদ্রিদ। কিন্তু চলতি মৌসুমে ধুঁকতে থাকা এসি মিলানকে তারা হারাতে তো পারলই না, বরং মিলানের কাছেই বিধ্বস্ত হলো কার্লো আনচেলত্তির দল।
মঙ্গলবার রাতে সান্তিয়াগো বের্নাবেউতে এসি মিলানের কাছে ৩-১ গোলে হেরেছে রিয়াল মাদ্রিদ।
এর ফলে পাঁচ বছরের বেশি সময় পর ঘরের মাঠে টানা দুই ম্যাচ হারল লা লিগা ও ইউরোপ চ্যাম্পিয়নরা। সবশেষ ২০১৯ সালে এমনভাবে হারে মাদ্রিদ জায়ান্টরা। ২০১৮-১৯ মৌসুমে ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে বের্নাবেউতে টানা চার ম্যাচ হেরে ক্লাবের ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে টানা হারের রেকর্ডটি গড়ে।
১৭ ফেব্রুয়ারি লা লিগায় জিরোনার বিপক্ষে ২-১ ব্যবধানে হারের পর কোপা দেল রের ম্যাচে ২৭ ফ্রেব্রুয়ারি বার্সেলোনার কাছে ৩-০ গোলে হারের মুখ দেখে রিয়াল মাদ্রিদ। এরপর ২ মার্চ লা লিগায় আবারও বার্সার কাছে ১-০ গোলে হারের পর চ্যাম্পিয়ন্স লিগে তাদের ৪-০ গোলে উড়িয়ে দেয় আয়াক্স। ফলে চরম বিপর্যয়ের পর সেবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ থেকে বিদায় নিতে হয় ইউরোপের ইতিহাসের সফলতম ক্লাবটিকে।
আজকের ম্যাচের শুরুতেই দলকে এগিয়ে নেন মালিক থিয়া। এরপর ২৩ মিনিটে পেনাল্টি থেকে ভিনিসিউস দলকে সমতায় ফেরানোর পর ৩৯তম মিনিটে মিলানকে আবারও এগিয়ে নিয়ে বিরতিতে যান আলভারো মোরাতা। বিরতির পর রিয়ালের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেন তিজানি রেইন্ডার্স।
এদিন শুরু থেকেই ভয়ডরহীন ফুটবল খেলতে থাকে দুদল। এর ফলস্বরূপ শুরুতেই দারুণ সুযোগ পেয়ে যান এমবাপে, কিন্তু কোনাকুনি শট লক্ষ্যে রাখতে ব্যর্থ হন তিনি। দুই মিনিট পর ছয় গজ বক্সের বাইরে সতীর্থের বাড়ানো বল পেয়েও শট নিতে ব্যর্থ হন এই ফরাসি ফরোয়ার্ড।
এরপরই দুর্দান্ত এক গোলে বের্নাবেউয়ের সমর্থকদের স্তব্ধ করে দেন থিয়া। দ্বাদশ মিনিটে ক্রিশ্চিয়ান পুলিসিকের কর্নার থেকে পাঠানো ক্রসে মাথা লাগিয়ে বল জালে পাঠিয়ে দেন এই জার্মান ডিফেন্ডার।
২৩তম মিনিটে পেনাল্টি আদায় করে তা থেকে গোল করে দলকে সমতায় ফেরান ভিনিসিউস।
জুড বেলিংহ্যামের বাড়ানো পাস ধরে এগিয়ে গিয়ে বক্সে ঢুকে পড়েন ভিনিসিউস, এরপর মিলানের ব্রাজিলীয় ফুলব্যাক এমেরসন রয়াল তাকে স্লাইড করে ফেলে দিলে সঙ্গে সঙ্গে পেনাল্টির বাঁশি বাজান রেফারি। দারুণ একটি পানেনকা স্পট কিকে গোলরক্ষককে পরাস্ত করে সমতা টানেন ভিনি।
ম্যাচের ৩১তম মিনিটে পরপর দারুণ দুটি শট হানে এসি মিলান। তবে প্রথমটি ডান পাশে ঝাঁপিয়ে কোনোমতে পোস্টের গোড়া থেকে বাইরে বের করেন লুনিন, দ্বিতীয়টি এগিয়ে গিয়ে লাফিয়ে উঠে ক্লিয়ার করেন তিনি।
৩৯তম মিনিটে দারুণ একটি আক্রমণ থেকে মিলানকে ফের এগিয়ে নেন মোরাতা। রিয়ালের অর্ধ থেকে বল কেড়ে নিয়ে দ্রুতগতিতে এগিয়ে গিয়ে বক্সের মধ্যে রাফায়েল লেয়াওকে ক্রস দেন ক্রিশ্চিয়ান পুলিসিক। এরপর পা দিয়ে বল নামিয়ে পেনাল্টি স্পটের কাছ থেকে বাঁ পাশে দুর্দান্ত এক শট নেন লেয়াও। লুনিন ঝাঁপিয়ে তা প্রতিহত করলেও আয়ত্তে রাখতে ব্যর্থ হলে বল খানিকটা সামনে চলে যায়। ছুটে গিয়ে তা নিজের সাবেক ক্লাবের জালে জড়িয়ে দেন মোরাতা।
প্রথমার্ধের নির্ধারিত সময়ের এক মিনিট বাকি থাকতে পাল্টা আক্রমণে উঠে ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে গিয়ে মিলানের বক্সে ঢুকে শট নেন এমবাপে। তবে আরও অসাধারণ নৈপুণ্যে তা প্রতিহত করেন মিলান গোলরক্ষক মাইক মাইনিয়ঁ।
এরপর অতিরিক্ত যোগ করা চার মিনিটে আর বলার মতো কোনো সুযোগ কেউ তৈরি করতে না পারলে ২-১ ব্যবধানে এগিয়ে থেকেই বিরতিতে যায় মিলান।
প্রথমার্ধে বল দখল থেকে শুরু করে আক্রমণ, গোলের সুযোগ তৈরি, শট- সব বিষয়েই রিয়াল মাদ্রিদের সঙ্গে সমানে টক্কর দেয় পাউলো ফনসেকার শিষ্যরা। রিয়ালের ৯টি শটের বিপরীতে মিলান শট নেয় আটটি, যেখানে দুদলই ৬টি করে শট লক্ষ্যে রাখতে পারে।
বিরতির পর মাঠে নেমেও রিয়ালকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে খেলতে থাকে মিলান। এরই ধারাবাহিকতায় ৫২তম মিনিটে আবারও জোড়া আক্রমণ শানায় তারা। প্রথমটিতে ডানদিক থেকে দূরের পোস্টের দিকে এমেরসন রয়ালের বাড়ানো ক্রসে হেডারে লক্ষ্যভেদ করেই ফেলেছিলেন লেয়াও, তবে লুনিনের নৈপুণ্যে সে যাত্রায় বেঁচে যায় রিয়াল। পরক্ষণেই সতীর্থের পাস পেয়ে বাঁ দিক দিয়ে বক্সে ঢুকে পড়েন মিলান ফুলব্যাক থেও এরনান্দেস। তবে গোলে শট নেওয়ার সময় তার সেই শট রিয়াল ডিফেন্ডারের পায়ে লেগে দিকভ্রষ্ট হয়।
প্রথমার্ধের হতাশা ঝেড়ে নতুন উদ্দমে খেলতে দুটি পরিবর্তন এনে দ্বিতীয়ার্ধে শিষ্যদের মাঠে নামান কার্লো আনচেলত্তি। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধেও রিয়ালের আক্রমণের ধার না বেড়ে উল্টো নিজেদের ছায়া হয়ে খেলছিলেন ভিনিসিউস-বেলিংহ্যামরা।
এরই মাঝে ৬২তম মিনিটে নিশ্চিত গোলের সুযোগ নষ্ট করেন এমবাপে। তাকে বক্সের মধ্যে ঢুকতে দেখে বল বাড়ান এক সতীর্থ, কিন্তু ফাঁকায় বল পেয়েও পোস্টের বাইরে মারেন এই ফরাসি স্ট্রাইকার।
৬৯তম মিনিটে কর্নার থেকে আসা ক্রসে পা ছুঁইয়ে গোল পেয়েই গিয়েছিলেন মোরাতা, কিন্তু তার সেই ফ্লিক শটটি ক্রসবারের কোণায় লেগে বাইরে চলে গেলে হতাশ হন ৩২ বছর বয়সী এই স্প্যানিশ ফরোয়ার্ড।
এরপর ৭৩তম মিনিটে সান্তিয়াগো বের্নাবেউতে গর্জন করে ওঠে মিলান সমর্থকরা; তিজানি রেইন্ডার্সের গোলে ৩-১ গোলে এগিয়ে যায় মিলান।
সতীর্থের কাছ থেকে বল পেয়ে বাঁ পাশ দিয়ে আক্রমণে উঠে রিয়ালের রক্ষণ ভেঙে বক্সে ঢুকে পড়েন রাফায়েল লেয়াও। এরপর গোলমুখে মাটি কামড়ানো জোরালো ক্রস দেন তিনি। সেখান থেকে কোনোমতে বল নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ঘুরেই লুনিনের দুই পায়ের মাঝ দিয়ে লক্ষ্যভেদ করেন রেইন্ডার্স।
দুই গোলে পিছিয়ে পড়ে হুঁশ ফেরে রিয়ালের। ৭৫তম মিনিট থেকে আক্রমণের পর আক্রমণে উঠতে থাকেন এমবাপে-ভিনিসিউসরা। তবে মিলানের রক্ষণে আক্রমণগুলো কাটা পড়ছিল বারবার।
এরই ধাবাহিকতায় ৭৯তম মিনিটে বাঁ পাশ দিয়ে বক্সে ঢূকেই দূরের পোস্ট বরাবর শট নেন ব্রাহিম দিয়াস। তবে ঝাঁপিয়ে তা ঠেকিয়ে দেন মাইনিয়ঁ।
এর দুই মিনিট পর রুয়েডিগারের পা থেকে দ্বিতীয় গোল পেয়ে যায় রিয়াল, কিন্তু অফসাইডে বাতিল হয়ে যায় গোলটি।
বক্সের বেশ বাইরে থেকে ছয় গজ বক্সের মধ্যে রুয়েডিগারের উদ্দেশে ক্রস দেন রিয়ালের এক খেলোয়াড়। তা পৌঁছানোর আগেই সামনে এগিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে সামনে ঠেলে দেন মাইনিয়ঁ। এরপর বল কিছুটা ডান পাশে থাকা রুয়েডিগারের সামনে গেলে জোরালো শটে অরক্ষিত গোলে বল পাঠিয়ে দেন তিনি। তবে রিভিউতে দেখা যায়, শুরুতেই যখন ক্রসটি আসছিল, তখন অফসাইডে ছিলেন এই জার্মান ডিফেন্ডার। ফলে ম্যাচে আর ফেরা হয়ে ওঠে না রিয়ালের।
এরপর ৮৮তম মিনিটে স্কোরলাইন ৪-১ করতে পারতেন রুবেন লফটাস-চিক, কিন্তু আবারও লুনিনের নৈপুণ্যে নিশ্চিত গোল খাওয়া থেকে বেঁচে যায় রিয়াল।
নির্ধারিত সময়ের খেলা শেষে যোগ করা ৬ মিনিটের প্রথম মিনিটে নিশ্চিত গোলের সুযোগ তৈরি করে রিয়াল মাদ্রিদ, কিন্তু লুনিনের মতোই অসাধারণ দক্ষতায় গোলটি ঠেকিয়ে দেন মাইনিয়ঁ।
পরে রিয়ালের খেলোয়াড়রা মাইনিয়ঁকে আর কোনো কঠিন পরিস্থিতিতে না ফেলতে পারলে জয়ের উল্লাসে মাতে মিলান।
এই জয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের প্রথম দুটি ম্যাচ হারের পর টানা দুই ম্যাচ জিতে ৬ পয়েন্ট নিয়ে টেবিলের তলানি থেকে ১৮তম স্থানে উঠেছে ফনসেকার শিষ্যরা। সমান পয়েন্ট নিয়ে গোল ব্যবধানে এগিয়ে থেকে এক ধাপ উপরে রিয়াল মাদ্রিদ।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগে রিয়ালের পরবর্তী ম্যাচ চলতি মৌসুমে এখনও সবগুলো ম্যাচ জেতা লিভারপুলের বিপক্ষে, অ্যানফিল্ডে। বায়ের লেভারকুজেনকে আজ রাতেই ৪-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে পূর্ণ ১২ পয়েন্ট নিয়ে প্রিমিয়ার লিগের মতো চ্যাম্পিয়ন্স লিগের টেবিলেরও শীর্ষস্থান দখল করে আছে তারা।
অন্যদিকে, তুলনামূলক দুর্বল প্রতিপক্ষ স্লোভান ব্রাতিস্লাভার বিপক্ষে পরের ম্যাচ খেলতে নামবে মিলান।
দিনের অপর ম্যাচে কোচ হিসেবে শেষ ম্যাচে ম্যানচেস্টার সিটিকে ৪-১ গোলে উড়িয়ে দিয়েছে রুবেন আমোরিমের স্পোর্তিং। এছাড়া শেষ মুহূর্তের গোলে স্ট্রাম গ্রাৎসকে ১-০ গোলে হারিয়েছে বরুশিয়া ডর্টমুন্ড, লাইপসিগকে ৩-১ গোলে হারিয়েছে সেল্টিক, আর দুই মাদ্রিদকে হারানোর পর এবার ইউভেন্তুসকে ১-১ গোলে রুখে দিয়েছে লিল।