কোনোভাবেই নির্বাচনের আগে গণভোট মানবে না বিএনপি: মির্জা ফখরুল
কোনোভাবেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন প্রস্তাবিত গণভোট বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) মেনে নেবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) দুপুরে রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন প্রদত্ত সুপারিশমালার পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির বিশ্লেষণ’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে এ কথা বলেন তিনি।
নির্বাচনের আগে গণভোটের বিরোধিতা করে মির্জা ফখরুল বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় সম্পর্কিত সুপারিশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে অথবা নির্বাচনের দিন গণভোট করা যেতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যেহেতু ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। সেক্ষেত্রে নির্বাচনের অনুষ্ঠানের আগে প্রস্তাবিত গণভোট অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। সময় ও নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বিপুল অঙ্কের ব্যয়ের বিবেচনায় এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ ব্যাপক লোকবল নিয়োগ এবং একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মতো বিশাল আয়োজনের বিবেচনায় নির্বাচনের পূর্বে গণভোট অনুষ্ঠান অযৌক্তিক এবং অবিবেচনাপ্রসূত।
সংস্কার বিএনপির অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক এজেন্ডা উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তীতে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঘোষিত ও গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোকে আমরা স্বাগত জানিয়েছি। সংস্কার কমিশনগুলোর কাছে আমরা সংবিধান, বিচারবিভাগ, নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার, প্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন ও পুলিশ প্রশাসন সংক্রান্ত বিষয়ে দলের পক্ষ থেকে বিস্তারিত মতামত দিয়েছি। অন্যান্য রাজনৈতিক দলও তাদের মতামত দিয়েছে। পরবর্তীতে ছয়টি সংস্কার কমিশনের সঙ্গে আমাদের এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের দীর্ঘ আলোচনা হয়। ছয়টি সংস্কার কমিশন প্রণীত সংস্কার প্রস্তাবগুলোর ওপরই দফাভিত্তিক আলাপ-আলোচনা হয়েছিল। সেই সমস্ত আলাপ-আলোচনার ফলস্বরূপ প্রণীত রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠিত হয়, যার সভাপতি প্রধান উপদেষ্টা।
লিখিত বক্তব্যে মির্জা ফখরুল আরও বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের প্রথম বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেছিলেন, যে সব বিষয়ে রাজনৈতিক দলসমূহের সাথে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে, সেই বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করে একটি জাতীয় সনদ প্রণীত ও স্বাক্ষরিত হবে। পরবর্তীতে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সেই সনদের বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করবে। তিনি জাতির উদ্দেশে দেয়া বিভিন্ন ভাষণেও তার এই বক্তব্য সুস্পষ্টভাবে পুনঃব্যক্ত করেছেন। জুলাই ঘোষণাপত্রেও এ বক্তব্য উদ্ধৃত হয়েছে।
‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দীর্ঘ ধারাবাহিক আলোচনায় কিছু কিছু বিষয়ে কিছু কিছু রাজনৈতিক দলের ভিন্নমত/নোট অব ডিসেন্টসহকারে ঐকমত্য হয়েছে। জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ যে ভাবে প্রণীত হয়েছে এবং স্বাক্ষরিত হয়েছে তাতে নোট অব ডিসেন্ট এর অংশে এ বক্তব্য স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে, ভিন্নমত/নোট অব ডিসেন্ট প্রদানকারী কোনো রাজনৈতিক দল বা জোট তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখপূর্বক যদি জনগণের ম্যান্ডেট লাভ করে, তাহলে তারা সেমতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। অতঃপর গত ১৭ অক্টোবর জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ স্বাক্ষরিত হয়’, বলেন ফখরুল।
ফখরুল আরও বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সব জাতীয় অনুষ্ঠান বিটিভিসহ অন্যান্য ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় সম্প্রচারিত হয়েছে, যা সমস্ত জাতি প্রত্যক্ষ করেছে। ঐতিহাসিক জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে আমরা কেবল অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করেছি। কিন্তু সেদিন জুলাই জাতীয় সনদের চূড়ান্ত কপি আমাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়নি। পরবর্তীতে প্রিন্টেড পুস্তক হিসেবে জুলাই জাতীয় সনদের কপি আমরা হাতে পাওয়ার পর আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে, ঐকমত্যের ভিত্তিতে সম্মত কয়েকটি দফা আমাদের অগোচরে পুনরায় সংশোধন করা হয়েছে।
লিখিত বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব উল্লেখ করেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় সম্পর্কিত সুপারিশ বলা হয়েছে, জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ এ সন্নিবেশিত সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত বিষয়গুলো কার্যকর করার উদ্দেশ্যে সরকার ‘‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ ২০২৫’’ শিরোনামে একটি আদেশ জারি করবে। এমন প্রস্তাবিত আদেশের একটি খসড়া সংযুক্তি-২ এবং সংযুক্তি-৩ এ সংযোজিত করা হয়েছে।
সরকারের কি এ রকম আদেশ জারি করার এখতিয়ার আছে? সংবিধানের ১৫২ নং অনুচ্ছেদের সংজ্ঞা অনুসারে ‘আদেশ’ আইনের মর্যাদাপ্রাপ্ত, অতএব সেটি রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার। বিকল্প প্রস্তাব ১ এ সরকার জুলাই সনদ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ খসড়া বিল গণভোটে উপস্থাপন করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিলের তফসিল-১ এ সংস্কার প্রস্তাবসমূহ সন্নিবেশিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে বিল সরকারি গেজেটে প্রকাশ করা হবে। বিলে উল্লেখ করা হয়েছে, সংবিধান সংশ্লিষ্ট তফসিল-১ এ বর্ণীত ৪৮টি দফার (জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবিত দফাগুলি) উপরে গণভোট হবে। ওই দফাগুলোর বিপরীতে স্বাক্ষরিত জুলাই জাতীয় সনদে অন্তর্ভুক্ত রাজনৈতিক দলের মতামত, ভিন্নমত, নোট অব ডিসেন্ট উল্লেখ করা হয়নি। অর্থাৎ ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব এবং সুপারিশ একপেশে ও জবরদস্তিমুলকভাবে জাতির উপরে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
বছরব্যাপী সংস্কার কমিশন ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের ধারাবাহিক আলোচনাকে অর্থহীন উল্লেখ করে ফখরুল বলেন, দীর্ঘ প্রায় বছরব্যাপী সংস্কার কমিশন ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের দীর্ঘ ধারাবাহিক আলোচনা ছিল অর্থহীন, প্রহসনমূলক এবং জাতির সঙ্গে প্রতারণার শামিল। গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্নমত থাকবে-এটাই স্বাভাবিক এবং সে কারণে সংলাপের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। কিন্তু ঐকমত্য কমিশন ভিন্নমত পোষণে রাজনৈতিক দলগুলোর গণতান্ত্রিক অধিকারকে আমলেই নেয়নি।
সংবিধান সংস্কার বিলটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, সংবিধান সংস্কার পরিষদ প্রথম অধিবেশন শুরুর তারিখ থেকে ২৭০ পঞ্জিকা দিবসের মধ্যে যদি সংস্কার সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয় তাহলে গণভোটে অনুমোদিত সংবিধান সংস্কার বিলটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে, যা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও হাস্যকর ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। জাতীয় সংসদে অনুমোদনের পর যে কোনো বিল রাষ্ট্রপতির অনুমোদনপ্রাপ্তির পরই কেবল আইনে পরিণত হয়। স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কোন সুযোগ নেই এবং তা গণতান্ত্রিক রীতি ও সংসদীয় সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী।
এআর
