বগুড়া-৭: শহীদ জিয়ার জন্মস্থানে কে হবেন প্রার্থী—খালেদা জিয়া না তারেক রহমান


রাজনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র বগুড়া-৭ (গাবতলী ও শাজাহানপুর) আসন। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জন্মস্থান এই আসনটি বিএনপির শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলটির প্রার্থী নিয়ে চলছে গুঞ্জন।
স্থানীয় নেতারা মনে করছেন, বিএনপি থেকে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নয়তো তার ছেলে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রার্থী হতে পারেন। তারা এখানে সর্বোচ্চ ভোটে জয়ী হয়ে আগামীতে সরকার গঠন করবে বিএনপি। তবে জামায়াতে ইসলামী থেকেও হেভিওয়েট প্রার্থী দেওয়া হয়েছে এই আসনে।
আসনটিতে ভোটার রয়েছেন পাঁচ লাখ ১২ হাজার ২৫৮ জন। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার সংখ্যা দুই লাখ ৫৭ হাজার ২৭৩। নারী ভোটার দুই লাখ ৫৪ হাজার ৯৮৩ জন। আর তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার ২ জন।
বিএনপির প্রার্থী নিয়ে জল্পনা-কল্পনা
বগুড়া-৭ আসনের রাজনৈতিক দৃশ্যপট সবসময়ই উত্তপ্ত থাকে। কারণ এটি শীর্ষ নেতা ও জাতীয় প্রতিপক্ষের জন্য সংরক্ষিত আসন হিসেবে বিবেচিত। আসনটিতে এ পর্যন্ত ১২টি জাতীয় সংসদ ও তিনটি উপনির্বাচন হয়েছে। এর মধ্যে ১০ বারই জয়ী হয়েছেন বিএনপির প্রার্থীরা। আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির প্রার্থী দুইবার করে ও একবার স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হয়েছে। আসনটিতে পাঁচবার নির্বাচন করে প্রতিবারই বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছেন খালেদা জিয়া। তিনি আসন ছেড়ে দেওয়ার পর তিনবার উপনির্বাচনে হেলালুজ্জামান তালুকদার লালু ও একবার প্রয়াত ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ জয়ী হয়েছেন।
এই আসনের সাবেক এমপি ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হেলালুজ্জামান তালুকদার লালুর ভাষ্যমতে, ‘বগুড়া-৭ বিএনপির শক্ত ঘাঁটি। ইতিহাস দেখলে বোঝা যায়, আমরা সর্বোচ্চ ভোটে দেশনেত্রীকে এখানে জয়ী করেছি। এটি কেবল একটি আসন নয়, রাজনৈতিক ও মানসিক জোর দেখানোর জায়গাও। আমরা এবারও গণজোয়ার তৈরি করে ধানের শীষের পক্ষে নির্বাচনী লড়াই তীব্র করবো।’
গাবতলী উপজেলা বিএনপির সভাপতি মোরশেদ মিল্টন বলেন, ‘এখানকার জনগণ দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির প্রতি আস্থা রাখছে। শুধু প্রার্থীই নয়, দলের রাজনৈতিক কৌশল, স্থানীয় সংগঠন ও সমর্থকদের একত্রিত করার ক্ষমতাও গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের লক্ষ্য স্থানীয় স্তরে শক্তিশালী সমর্থন নিশ্চিত করা, যাতে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যে প্রার্থী দেন তিনি সহজেই মাঠে বিজয়ী হতে পারেন।’
এই আসনে সবসময় হেভিওয়েট প্রার্থীরা লড়াইয়ে অংশ নেন। তাই মনোনয়ন প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নেওয়া হয়। দলের ভেতরের সমীক্ষা, জনমত ও ভোটারের প্রবণতা যাচাই করে দেওয়া হয় দলের টিকিট।
জামায়াতের হেভিওয়েট প্রার্থী
শুধু বিএনপি নয়, জামায়াতে ইসলামী এখানে শক্তিশালী প্রার্থী নিয়ে মাঠে নামার পরিকল্পনা করেছে। জেলা শাখার সাবেক আমির গোলাম রব্বানীকে এবারের নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছে দলটি। গোলাম রব্বানী এলাকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক পরিচিত মুখ। দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় তিনি।
স্থানীয় নেতা ও সমর্থকরা বলছেন, তার পরিচিতি এবং রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা তাকে ভোটের মাঠে অন্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় এগিয়ে রাখবে। তিনি শুধু ভোটের হিসাব-নিকাশের জন্য নয়, জনগণের কাছে তার দৃষ্টিভঙ্গি ও কার্যক্রমের জন্যও সমর্থন পাবেন।
প্রার্থিতার বিষয়ে গোলাম রব্বানী বলেন, ‘আমি এলাকায় বহু বছর ধরে রাজনীতি করেছি। জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক, স্থানীয় সংগঠনগুলোকে সমন্বয়, সমস্যা সমাধানের জন্য সরাসরি উপস্থিত থাকা—সবকিছুই আমার পরিচিতি তৈরি করেছে। ভোটের মাঠে এটি আমাকে এগিয়ে রাখবে বলে আশা রাখি।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি জামায়াত এই আসনে সক্রিয় প্রচারণা চালায়, তবে বিএনপি এবং অন্যদলের জন্য এটি নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। ভোটাররা হেভিওয়েট প্রার্থীর সঙ্গে পরিচিত থাকলে, তাদের মনোভাব নির্বাচনী ফলাফলে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে।
বগুড়া-৭ আসন রাজনীতির এক উত্তপ্ত কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। নির্বাচনী লড়াইটা হবে তীব্র।
স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই আসনে শুধু ভোটের সংখ্যা নয়, রাজনৈতিক প্রতীক ও মানসিক প্রভাবও গুরুত্বপূর্ণ। যে দল এখানে জয়ী হবে, তার প্রভাব পুরো জেলার রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পড়বে।
আসন্ন নির্বাচনে পরিস্থিতি তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার দিকে এগোচ্ছে। বিএনপি ও জামায়াত দুই দলেরই শক্তিশালী প্রার্থী। ফলে রাজনৈতিক উত্তাপ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরও বেড়ে যাবে।
শুধু প্রত্যাশাই নয়, স্থানীয় ভোটারদের মধ্যে অতীতের হতাশাও আছে। স্থানীয় কৃষক আকবর আলী বলেন, ‘প্রার্থীরা আসে, ভোট নেয়, তারপর চলে যায়। আমাদের সমস্যা থেকেই যায়। আমরা স্থায়ী সমাধান চাই।’
আরেক ভোটার আমির আলী বলেন, ‘ভোট একটি গোপনীয় বিষয়। আমরা নিজের ইচ্ছেয় ভোট দিতে চাই। কেউ যেন আমাদের জোর করে ভোটাধিকার হরণ করতে না পারে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।’
নির্বাচনী বিশ্লেষকদের মতে, বগুড়া-৭ আসন কেবল একটি নির্বাচনী ক্ষেত্র নয়, এটি রাজনৈতিক ইতিহাস, স্থানীয় প্রত্যাশা, শহীদ জিয়ার জন্মস্থান। এই আসনের প্রতিটি ভোট শুধু সংখ্যার জন্য নয়, মানসিক ও রাজনৈতিক শক্তিরও প্রতীক। ভোটাররা আশা করছেন, এবার প্রার্থীরা শুধু প্রতিশ্রুতি না দিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ দেখাবেন।
প্রবীণ রাজনীতিবিদ মোনায়েম হকের মতে, এই আসনের ফলাফল কেবল এখানেই নয়, পুরো জেলার রাজনৈতিক মানচিত্রকেও প্রভাবিত করে। তাই যে প্রার্থী নির্বাচনে জিতবেন, তার ভূমিকা শুধু সংসদে নয়, স্থানীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও জনমতের ওপরও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে।