মিরপুরের ঝিলপাড় বস্তিতে চলছে মাদক ও অস্ত্রের রমরমা ব্যবসা
প্রশাসনের নাকের ডগায় থেকেও মিরপুরের পল্লবী আলোকদি ঝিলপাড় বস্তিতে চলছে মাদক ও অস্ত্রের রমরমা ব্যবসা। সাংবাদিকদের আবাসনের জন্য জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের বরাদ্দকৃত জায়গা দখল করে অবৈধ বস্তি গড়ে তুলে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) ইলিয়াস মোল্লার নিয়ন্ত্রণে চলছে এ অবৈধ ব্যবসা।
মাদক ও অস্ত্রের অবাধ কারবারের কারণে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে এই বস্তি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে এসবে বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে চরম হতাশা বিরাজ করছে।
সূ্ত্র জানায়, ২০০৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নির্দেশে প্রায় ৩০০ সাংবাদিক পরিবারের জন্য আবাসন গড়ে তুলতে ঢাকা সাংবাদিক সমবায় সমিতিকে রাজধানীর পল্লবীর ঝিলপাড় মসজিদের পাশে ৭ একর জমি বরাদ্দ দেয় জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ।
এরপর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে এই বিশাল জমি দখলে নেন ঢাকা-১৬ আসনের এমপি ইলিয়াস মোল্লা। জমির একাংশে তিনি বস্তি বানিয়ে ভাড়া দেন এবং অন্য অংশে গড়ে তোলেন গরুর খামার। বস্তি, দোকান ও অস্থায়ী মার্কেট করার পর সেখানে অবৈধভাবে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও ওয়াসার পানি সংযোগেরও ব্যবস্থা করেন ইলিয়াস। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকে আত্মগোপনে থাকলেও নিজস্ব বাহিনীর মাধ্যমে প্রতি মাসে ভাড়া তুলে চলেছেন তিনি।
সরকার পতনের পর দেশে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা গা ঢাকা দিলেও এই বস্তিতে তার নিয়ন্ত্রণ অটুট রয়েছে। আত্মীয় ও দলীয় লোকের মাধ্যমে অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন ইলিয়াস মোল্লা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাংবাদিকদের জন্য বরাদ্দকৃত জায়গার কিছু অংশে ইলিয়াস মোল্লা নিজেই অবৈধভাবে গরুর খামার স্থাপন করেন। পরবর্তী সময়ে তার বোনের ছেলে সালমান মোল্লা সেখানে বস্তি ও দোকান ঘর স্থাপন করে ভোগদখল করে আসছেন।
শুধুমাত্র বিদ্যুৎ বিল বাবদই বস্তিবাসীর কাছ থেকে প্রতি মাসে ৪ লাখ টাকা করে চাঁদা তোলেন সালমান মোল্লা। আর বস্তির পূর্ব পাশের অবৈধ স্থাপনা থেকে তার মাসিক আয় অন্তত তিন লাখ টাকা।
এদিকে, ইলিয়াস মোল্লার ছোট ভাই আলী মোল্লার দেহরক্ষী চিকন হারিসের নেতৃত্বে সাব্বির ও গাজী নামের দুই ব্যক্তি ওই জায়গার পশ্চিম পাশে নির্মিত স্থাপনা থেকে বস্তি ও দোকান ঘর ভাড়াবাবদ প্রতি মাসে তিন লাখ থেকে চার লাখ টাকা চাঁদা তোলেন।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, সহযোগী সোহেল, ফারুক ও আনোয়ারকে নিয়ে ওই এলাকায় ইয়াবা ও গাঁজাসহ মাদকদ্রব্য বিক্রি করে আসছেন আলোকদি এলাকার স্থানীয় সন্ত্রাসী সামছু। মাদক বিক্রির জন্য আনোয়ার ও ফারুকের টং দোকান ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
এছাড়া, ঝিলপাড় নতুন রাস্তা নিয়ন্ত্রণ করেন সালমান মোল্লার ড্রাইভার ফজলু। মন্দির থেকে মোড় পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করেন আলী মোল্লার অফিসের স্টাফ বেলাল ও মাসুদ। জসিম মোল্লার হয়ে বস্তি নিয়ন্ত্রণ করেন তুফান।
ইলিয়াস মোল্লার ভাগ্নে সালমান মোল্লার হয়ে টাকা ওঠান ড্রাইভার ফজলু। জসিম মোল্লার হয়ে টাকা ওঠান তুফান। আর আলী মোল্লার হয়ে টাকা ওঠান বিল্লাল।
বস্তির অদূরেই ইলিয়াস মোল্লার বাড়ি গিয়ে ফটকে তালা ঝুলতে দেখা যায়। ৫ আগস্টের পর থেকে বাড়িতে ইলিয়াস মোল্লা এবং তার স্ত্রী-সন্তানের কাউকে দেখেননি বলে স্থানীয়রা জানান।
এলাকাবাসীর আশঙ্কা, বস্তিতে লুকিয়ে থাকা সন্ত্রাসীদের হাতে ৫ আগস্ট বিভিন্ন থানা ও নিরাপত্তাবাহিনীর হেফাজত থেকে লুট হওয়া অস্ত্রের কিছু থাকতে পারে। মিরপুর এলাকায় অপরাধ কর্মকাণ্ডে এসব অস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে বলে ধারণা তাদের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা সাংবাদিক সমবায় সমিতির সভাপতি সদরুল হাসান বলেন, ‘দখলমুক্ত করতে বহুবার গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের দ্বারস্থ হয়েছি। একপর্যায়ে জমির কিছু অংশ আমাদের বুঝিয়ে দেওয়া হলে সেখানে অস্থায়ী স্থাপনাও তৈরি করি। কিন্তু কিছুদিন পরই ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লা লোক পাঠিয়ে তা ভেঙে দেন।’
তিনি বলেন, ‘গত ২৮ আগস্ট গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার কাছে এ বিষয়ে আবেদন করেছি। গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করলে পুলিশ সংকটের কারণে তিনি উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছেন না বলে জানান।’
স্থানীয়রা জানান, নিজের নির্বাচনি এলাকা হওয়ায় সেখানে গত ১৬ বছর ধরে ইলিয়াস মোল্লার কথাই ছিল আইন। জমি ছাড়াও বহু দোকান, মার্কেট, বাসস্ট্যান্ড ও ফুটপাত দখলে নিয়েছেন তিনি। এসব নিয়ে কেউ অভিযোগ করলে বাড়ির বৈঠকখানায় সালিশ বসিয়ে তিনি আদালতের আদলে বিচার করতেন। বিচার না মানলে নিজে মারধর করতেন; মামলা দিয়ে পুলিশে দেওয়ার হুমকিও দিতেন।
তারা জানান, বিচারের রায় পক্ষে দেওয়ার জন্য সহকারীদের মাধ্যমে ঘুষও নিতেন ইলিয়াস। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাডার পাঠিয়ে শিক্ষার্থীদের শায়েস্তা এবং মিরপুর এলাকায় আন্দোলনে অতর্কিত হামলার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
তবে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ওই এলাকায় এসব দৌরাত্ম্য থেকে রেহাই চেয়েছেন স্থানীরা।