সর্বোচ্চ তিনটি আসন থেকে ভোটে লড়তে পারবেন এক ব্যক্তি
                                
                                                                                    জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ তিনটি আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন। এই বিধান সংযোজন করে নির্বাচনসংক্রান্ত আইন, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ বা আরপিও (সংশোধন) অধ্যাদেশের খসড়া অনুমোদন দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ।
সোমবার (৩ নভেম্বর) নির্বাচন কমিশন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ছিল, একাধিক আসনে কোনো ব্যক্তির প্রার্থী হওয়ার বিধান বাতিল করা। কমিশন জানিয়েছে, এ সুপারিশ মূলত দুটি কারণে করা হয়েছে। প্রথমটি হলো উপনির্বাচনের ব্যয় কমানো, এবং দ্বিতীয়টি হলো প্রভাবশালী কোনো প্রার্থীকে একাধিক আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না দিয়ে সংশ্লিষ্ট আসনের প্রকৃত প্রার্থীদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করা।
নির্বাচন কমিশনের সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলি বলেন, ১৯৮৬ সালে প্রথমবারের মতো পাঁচটি আসনে একজনের প্রার্থী হওয়ার বিধান যুক্ত করা হয়। আরপিওতে আগে একজন কয়টি আসনে ভোট করবেন, তা উল্লেখ ছিল না; নতুন দফা যুক্ত করে ১৯৮৬ সালে পাঁচটি আসন সীমাবদ্ধ করা হয়। ২০০৮-২০০৯ এ এসে তা তিনটি আসনে সীমাবদ্ধ করা হয়।
১৯৮৬ সালে সর্বোচ্চ পাঁচটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ রাখা হয়
২০০৮ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ড. এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন সংসদ নির্বাচনে এক ব্যক্তির দুই বা ততোধিক আসনে প্রার্থী হওয়ার বিষয়টি নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করেছিল। ওই সময় নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী আইন সংস্কারে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে লিখিতভাবে জানিয়েছিল, বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি সংসদ নির্বাচনে দুই বা ততোধিক আসনে প্রার্থী হতে পারেন। তবে ১৯৮৬ সালে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধন করে সর্বোচ্চ পাঁচটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ রাখা হয়েছিল।
ইসি জানিয়েছে, অনেক প্রার্থী একের অধিক, এমনকি সর্বোচ্চ পাঁচটি আসনে প্রার্থী হয়েছেন। কোনো প্রার্থী একাধিক আসনে নির্বাচিত হলে সংবিধানের ৭১ অনুচ্ছেদ (২)(ক) অনুযায়ী তাকে একটিমাত্র আসন রেখে বাকি আসনগুলো ছেড়ে দিতে হয়। এই শূন্য ঘোষিত আসনগুলোতে পুনর্নির্বাচন আয়োজন করতে হয়, যা ব্যাপক প্রস্তুতি ও প্রচুর অর্থ ব্যয় দাবি করে।
এই প্রেক্ষাপটে সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সর্বোচ্চ তিনটি আসনে প্রার্থিতা সীমিত করা যুক্তিযুক্ত এবং পুনর্নির্বাচনের সম্ভাব্য ব্যয় কিছুটা কমানোর উদ্দেশ্যেও সমীচীন।
সেসময় নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে প্রস্তাব রাখে, ‘কোনো ব্যক্তি একই সময়ে তিনটির অধিক নির্বাচনী এলাকার জন্য প্রার্থী হতে পারবেন না। একাধিক আসনে মনোনয়নপত্র দাখিল করলে অতিরিক্ত প্রতিটি আসনের জন্য পাঁচ লাখ টাকা জমা দিতে হবে এবং জয়লাভ করে এরূপ আসন ছেড়ে দিলে এই জামানত বাজেয়াপ্ত করা হবে।’
নির্বাচন কমিশনের সর্বোচ্চ তিনটি আসনের প্রস্তাব সেসময় আইনে পরিণত হয়। তবে অতিরিক্ত প্রতিটি আসনের জন্য পাঁচ লাখ টাকা জামানত এবং নির্বাচনে জয়ের পর সেই আসন ছেড়ে দিলে ওই জামানত বাজেয়াপ্ত করার প্রস্তাবটি গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এদিকে সংসদ নির্বাচনের আইন বা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে এক ব্যক্তির একাধিক আসনে প্রার্থী হওয়ার বিষয়টি নির্দিষ্ট করে দেওয়া হলেও সংবিধানে এ বিষয়ে কোনো সংশোধনী আনা হয়নি।
সংবিধানের ৭১ অনুচ্ছেদের (১) দফায় বলা আছে, ‘কোনো ব্যক্তি একই সময়ে দুই বা ততোধিক নির্বাচনী এলাকার সংসদ সদস্য হইবেন না।’ (২) দফায় বলা আছে, ‘কোনো ব্যক্তির একই সময়ে দুই বা ততোধিক নির্বাচনী এলাকা হইতে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ায় এই অনুচ্ছেদের (১) দফায় বর্ণিত কোনো কিছুই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করিবে না, তবে তিনি যদি একাধিক নির্বাচনী এলাকা হইতে নির্বাচিত হন তাহা হইলে (ক) তাঁহার সর্বশেষ নির্বাচনের ৩০ দিনের মধ্যে তিনি কোন নির্বাচনী এলাকার প্রতিনিধিত্ব করিতে ইচ্ছুক, তাহা জ্ঞাপন করিয়া নির্বাচন কমিশনকে একটি স্বাক্ষরযুক্ত ঘোষণা প্রদান করিবেন এবং তিনি অন্য যেসব নির্বাচনী এলাকা হইতে নির্বাচিত হইয়াছিলেন, অতঃপর সেই সব এলাকার আসনসমূহ শূন্য হইবে।’
২০১৮ সালের জাতীয় সংসদে এ বিষয়ে সংশোধনী প্রস্তাব দেওয়া হয়। স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য রুস্তম আলী এই সংশোধনীর প্রস্তাবে উল্লেখ করেন, ‘সংবিধানে বলা আছে, একই সময়ে এক ব্যক্তি দুই বা ততোধিক নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রার্থী হতে পারবেন। অর্থাৎ একই ব্যক্তি একই সময়ে ১০০ বা ২০০ যে কয়টি আসন থেকে ইচ্ছা নির্বাচন করতে পারবেন।’
আবার গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) বলা আছে, ‘একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ তিনটি নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রার্থী হতে পারবেন। এতে সংবিধান ও আরপিওর বিধানে সাংঘর্ষিক অবস্থা তৈরি হয়েছে। এজন্য সংবিধানের ৭১ অনুচ্ছেদটি সংশোধন প্রয়োজন।’ সেসময় এই প্রস্তাব পরীক্ষা করে বিবেচনার জন্য আইন মন্ত্রণালয়কে বলা হলেও পরে আর অগ্রগতি হয়নি।
যারা সর্বোচ্চ পাঁচটি আসনে নির্বাচিত হয়েছিলেন
১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে ২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনের মধ্যে প্রতিটি নির্বাচনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সর্বোচ্চ পাঁচটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন এবং সব আসনেই জয়ী হয়েছেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে সর্বোচ্চ তিনটি আসনের বিধান থাকায় তিনি তিনটি আসনে প্রার্থী হয়ে সবকটিতেই জয়ী হন।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পঞ্চম ও সপ্তম সংসদ নির্বাচনে পাঁচটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সবটিতেই জয়ী হন। ২০০৮ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনে তিনি তিনটি আসনে নির্বাচন করে তিনটিতেই জয়ী হন।
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে একটিতে জয়ী হন। সপ্তম সংসদ নির্বাচনে তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনটিতেই জয়ী হন। অষ্টম সংসদ নির্বাচনে পাঁচটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে চারটিতে জয়ী হন এবং ২০০৮ সালে তিনটি আসনে প্রার্থী হয়ে তিনটিতেই জয়ী হন। এর ফলে পাঁচটি আসনে জয়ী হওয়ার রেকর্ড শেখ হাসিনা অর্জন করতে পারেননি। এই কারণেই পাঁচটি আসনের বদলে সর্বোচ্চ তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিধান আরপিওতে চূড়ান্ত করা হয়েছে।
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তিনটি আসন থেকে নির্বাচন করবেন। জানা গেছে, তিনি ফেনী-১, বগুড়া-৭ ও দিনাজপুর-৩ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
