নৃশংসতার ১৭টি ভিডিও দেখলেন ট্রাইব্যুনাল, টিস্যু দিয়ে চোখ মুছলেন সাবেক আইজিপি মামুন


বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে সারা দেশে ছাত্র-জনতার ওপর চালানো হয় ভয়াবহ নৃশংসতা। ওই নৃশংসতার ১৭টি ভিডিও ট্রাইব্যুনালে দেখানো হয়; যা সরাসরি সম্প্রচার করা হয় বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাধ্যমে।
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে করা মামলায় সর্বশেষ সাক্ষী হিসেবে আজ রোববার ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার উপপরিচালক মো. আলমগীর জবানবন্দি দেওয়ার সময় ভিডিওগুলো প্রচার করা হয়। তিনি এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। তবে জবানবন্দি শেষ না হওয়ায় আগামীকাল সোমবার পরবর্তী দিন ধার্য করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
এর আগে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেওয়া সদ্যপ্রয়াত লেখক, গবেষক ও রাজনীতিবিদ বদরুদ্দীন উমরের জবানবন্দি সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করার জন্য ট্রাইব্যুনালের কাছে আবেদন করেন প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম।
তিনি বলেন, ট্রাইব্যুনালের আইনে এর বিধান রয়েছে এবং অতীতে তা হয়েছে। পরে ট্রাইব্যুনাল তা মঞ্জুর করেন।
শেখ হাসিনা ছাড়া এই মামলার অপর দুই আসামি হলেন আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক প্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। শেখ হাসিনা ও কামাল পলাতক। আর চৌধুরী মামুন এরই মধ্যে রাজসাক্ষী হিসেবে এই মামলায় জবানবন্দি দিয়েছেন।
ট্রাইব্যুনালে প্রথমে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের একটি ডকুমেন্টারি দেখানো হয়। এরপর দেখানো হয় শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনের ভিডিও; যেখানে তিনি আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ হিসেবে সম্বোধন করেন।
শেখ হাসিনার বক্তব্যের সূত্র ধরে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এবং সেখানে ছাত্রলীগের হামলা, রংপুরে আবু সাঈদের ওপর পুলিশের গুলির দৃশ্য দেখানো হয়।
র্যাবের হেলিকপ্টার থেকে গুলি করার ভিডিও দেখানোর পর প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, টেলিফোনে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী গুলি ও বোম্বিং করা হচ্ছে।
তখন আপত্তি জানান হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন।
তিনি বলেন, ‘আমি হেলিকপ্টার থেকে গুলি করতে দেখিনি।’
তখন ভিডিও আবার দেখানো হয়; যেখানে গুলি করা এবং বোম্বিং করার ফুটেজ দেখে প্রসিকিউশনের বক্তব্য মেনে নেন তিনি।
ট্রাইব্যুনালে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে আসাদুজ্জামানকে দেখানো (‘গুলি করি মরে একটা, বাকিগুলো যায় না’) ভিডিও; যাত্রাবাড়ীতে এক পুলিশ কর্মকর্তার ছেলেকে কাছ থেকে গুলি করে হত্যা; যাত্রাবাড়ীতে খোকন চন্দ্র বর্মণকে গুলি করে মুখমণ্ডল বিকৃত করা; সাভারে তরুণকে এপিসি থেকে ফেলে দেওয়া ও কাছ থেকে আন্দোলনকারীদের পুলিশের গুলি; আশুলিয়ায় পাঁচ মরদেহ ও জীবন্ত একজনকে পুলিশের গাড়িতে তুলে অগ্নিসংযোগ; চানখাঁরপুলে কাছ থেকে আন্দোলনকারীদের গুলি করে হত্যা; রামপুরায় কার্নিশে ঝুলে থাকা একজনকে গুলি; ফার্মগেটে গুলি করে হত্যা এবং যাত্রাবাড়ী থানার সামনে খুব কাছ থেকে গুলি করে বেশ কয়েকজনকে হত্যার ভিডিও দেখানো হয়।
সবচেয়ে নৃশংস ছিল ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ী থানার সামনে চালানো ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য; যেখানে দাঁড়িয়ে থাকা জনতার মাঝে গ্রেনেড ছুড়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করতে দেখা যায় এক পুলিশ সদস্যকে। পরে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশ গুলিবর্ষণ করেছে বৃষ্টির মতো। মাত্র কয়েক গজ দূর থেকেও গুলি করা হয়। এমনকি গুলিতে আহত হয়ে কাতরাতে থাকা ব্যক্তিকে আবারও গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করতে দেখা যায় পুলিশ সদস্যদের।
ভিডিওগুলো দেখানোর সময় অনেককে চোখ মুছতে দেখা যায়। অনেকের চোখে পানি ছলছল করছিল। এমনকি কাঠগড়ায় বসে থাকা পুলিশের সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে টিস্যু দিয়ে চোখ মুছতে দেখা গেছে। এ সময় ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ফার্মগেটে পুলিশের গুলিতে মারা যাওয়া গোলাম নাফিজের মা-বাবাকে কাঁদতে দেখা যায়।
ভিডিও ফুটেজ দেখানো শেষ হলে জবানবন্দি দেন তদন্ত কর্মকর্তা আলমগীর।
তিনি জবানবন্দিতে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে প্রকাশিত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াসহ বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনার কথা জানান।
সেই সঙ্গে আন্দোলন দমনে আদেশ, নির্দেশ ও উসকানিমূলক বিবৃতি, লেখনী, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত পোস্ট ও মন্তব্য পর্যালোচনা, আন্দোলনে শহীদ ব্যক্তিদের পরিবার, আন্দোলনে আহত জুলাই যোদ্ধাসহ সাক্ষীদের জিজ্ঞাসাবাদপূর্বক তাঁদের বক্তব্য লিপিবদ্ধ করা, পত্রপত্রিকা, ভিডিও ফুটেজসহ আলামত জব্দ করা, ভিন্ন সরকারি-বেসরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কাছ থেকে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংবলিত প্রতিবেদন সংগ্রহ করা এবং বিভিন্ন ঘটনাস্থলসহ আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা প্রদানকারী কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল পরিদর্শন করে তথ্য সংগ্রহের কথা জানান।