উত্তরে হারিয়ে যাচ্ছে শতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী বাঁশ শিল্প

Bangla Post Desk
ইউএনবি
প্রকাশিত:২৪ আগস্ট ২০২৫, ০৯:৪১ এএম
উত্তরে হারিয়ে যাচ্ছে শতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী বাঁশ শিল্প

উত্তরের বিভিন্ন গ্রামে একসময় বাঁশ শিল্পের জমজমাট ব্যবসা ছিল। কিন্তু কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে সেই শিল্প। ডিজিটাল প্রযুক্তি প্রবেশ করায় গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী বাঁশ শিল্প এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে।

রংপুর বিভাগীয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প অধিদপ্তর জানায়, উত্তরের ৮ জেলার ১১৪টি গ্রামের মানুষ বাঁশ শিল্পে কর্মরত থেকে পরিবার-পরিজন পরিচালনা করত। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় দেশ ডিজিটাল এবং আধুনিকায়নের যুগে প্রবেশ করায় ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প এখন হারিয়ে যেতে বসেছে।

রংপুরের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার আবু জাফর জানান, একসময় বাঁশ শিল্পে এই অঞ্চলের ৭০ হাজার পরিবার তাদের জীবিকা নির্বাহ করত। কিন্তু বর্তমানে এই শিল্পে কর্মরত রয়েছে মাত্র ১২ হাজার পরিবার। প্রতিদিনই কমছে এই শিল্পের ব্যবহার। তাই এই শিল্পের শিল্পীরা এখন পেশা বদল করতে বাধ্য হচ্ছেন।

এই চিত্র শুধু রংপুরেই নয়, উত্তরের ৮ জেলা লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়েও। আধুনিকতার কারণে এসব জেলা থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে বাঁশ শিল্প।

তবে বিসিকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শিল্পটি ধরে রাখতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার।

সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, একসময় বাঁশ কাটার শব্দে মুখর থাকত রংপুরের গঙ্গাচড়ার বড়বিল ইউনিয়নের মনিরাম গ্রাম। গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে ছিল বাঁশের তৈরি হস্তশিল্প— ডালি, কুলা, ঝুড়ি, চাটাই, হাঁস-মুরগির টোপা, মাছ ধরার ফাঁদ, হাতপাখা থেকে শুরু করে নানা প্রয়োজনীয় ও নকশাদার সামগ্রী। এই শিল্পই ছিল গ্রামের অনেক পরিবারের একমাত্র জীবিকা। তবে আধুনিকতার স্রোতে হারিয়ে যেতে বসেছে শত বছরের এই ঐতিহ্য। এখন বাঁশের কাজ করা মানুষগুলো টিকে থাকার লড়াইয়ে হেরে যাচ্ছেন।

মনিরামের প্রবীণ বাঁশশিল্পী আবদুল ওয়াহেদ (৮৫) বলেন, ‘আমার বাবার হাত ধরে এই কাজ শিখেছি। আগে অনেক অভাব-অনটন ছিল, এই কাজ করেই আমাদের ১৪ ভাই-বোনের সংসার চালাতেন বাবা। কখনোই হিমশিম খেতে হয়নি তাকে। বাবার আমল থেকে বাঁশের কাজ করছি। কিন্তু আগে যেমন বেচাবিক্রি হত, এখন আর সে রকম হয় না।’

নগরায়নের দৌঁড়ে পাল্লা দিয়ে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগছে বাংলাদেশের গ্রামগুলোতেও। ফলে গড়ে উঠছে নতুন নতুন জনবসতি। কমে যাচ্ছে কৃষি জমি ও বনাঞ্চল। গ্রামাঞ্চলে এখন বাঁশবন উজাড় করা হচ্ছে। তাই একদিকে বাড়ছে বাঁশের দাম, অন্যদিকে কমছে এর সহজলভ্যতা। ফলে এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে বাঁশশিল্পীদের কর্মসংস্থানে।

মনিরামের বাঁশশিল্পী কেনজুল বলেন, ‘আগে বাঁশ শিল্পের সোনালী অতীত ছিল, এখন সেগুলো কেবলই গল্প। আগে বাঁশ পাওয়া যেত ৫০ থেকে ১০০ টাকায়। আর এখন কিনতে হয় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায়। একটা বাঁশ দিয়ে পাশ থেকে ছয়টি মুরগির টোপা তোলা সম্ভব। একটা টোপা আমরা পাইকারদের কাছে বিক্রি করি ১০০ টাকায়। তাহলে সারা দিন পরিশ্রম করেও আমাদের লাভ তেমন থাকে না।’

বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি আসার পর শাশুড়ির কাছে কুলা বানাতে শেখেন হাসনা বেগম। আজ শ্বশুর-শাশুড়ি নেই, কিন্তু তিনি ধরে আছেন সেই পেশা। ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিকেও দিয়েছেন সেই শিক্ষা।

আরেক বয়োবৃদ্ধা শিল্পী মোমেনা বলেন, ‘এখন সব কিছুরই দাম বেড়েছে। বাঁশ, তার সবকিছুর। এই অবস্থায় এই পেশা টিকিয়ে রাখা খুবই কষ্টকর। আমরা পেশা টিকিয়ে রাখতে দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে লাভের ওপরে টাকা নেই। ১০০০ টাকায় ১০০ টাকা মাসে লাভ দিতে হয়। ৫ হাজার টাকায় মাসে লাভ দিতে হচ্ছে ৫০০ টাকা। এ ঋণ যেন সংসারের বিরাট বোঝা। কোনো মাসে টাকা দিতে দেরি হলে শুনতে হয় নানা কথা। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এই জীবিকা আর সহজতর হবে বলে মনে করি।’

এখন আর আগের মতো অর্ডার আসে না। আসে না হাটের আগের রাতের ব্যস্ততা। ফলে গ্রামের অনেকেই বাধ্য হয়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন। কেউ দিনমজুরি করেন, কেউ শহরে রিকশা চালান। যারা এখনো এই শিল্প আঁকড়ে ধরে আছেন, তারাও পড়েছেন চরম দুশ্চিন্তায়। কারণ পুঁজি নেই, বাজার নেই, আর নেই কোনো সরকারি সহযোগিতা।

বাঁশশিল্পী দুলালী বলেন, ‘বাঁশ কিনে আনতেও এখন অনেক টাকা লাগে। তারপর বানিয়ে বাজারে নিয়ে গেলেও বিক্রি হয় না। ঋণ নিতে চাইলেও কেউ দেয় না। হাতেই টাকা নাই, সরকার থেকেও কোনো সাহায্য পাইনি।’

স্থানীয় ইউপি সদস্য লেবু মিয়া বলেন, ‘মনিরামে অনেক প্রতিভাবান বাঁশশিল্পী আছেন, কিন্তু তাদের আর্থিক সহায়তা, প্রশিক্ষণ ও পণ্য বাজারজাত করার কোনো সুযোগ নেই। সরকারিভাবে উদ্যোগ নিলে এই ঐতিহ্য আবারও ফিরে আসতে পারে।’

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) বাংলা বিভাগের প্রধান ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ‘বিশেষজ্ঞদের মতে, বাঁশশিল্প শুধু একটি পেশা নয়, এটি টেকসই, পরিবেশবান্ধব ও গ্রামীণ জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আধুনিক ডিজাইন, প্রশিক্ষণ ও অনলাইন বিপণন প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে যুক্ত করলে এই শিল্প আবারও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে।’

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের রংপুর উপ-মহাব্যবস্থাপক এহসানুল হক বলেন, ‘আমাদের উপজেলাপর্যায়ে বিসিকের কোনো অফিস নেই। ফলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শিল্পগুলোর সঙ্গে জড়িত লোকেরা আমাদের সঙ্গে সেভাবে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারছেন না। মনিরামের বাঁশশিল্পীদের প্রয়োজন হলে তারা বিসিকে যোগাযোগ করবে। আমরা অবশ্যই তাদের ঋণের ব্যবস্থা করব।’

মনিরামের বাঁশশিল্প এখন শুধুই ইতিহাস হয়ে যাওয়ার পথে। একটু সহানুভূতি, একটু পৃষ্ঠপোষকতা আর আধুনিক চিন্তার ছোঁয়ায় হয়তো এই হারিয়ে যাওয়া শিল্প আবারও জীবিত হতে পারে একটি গ্রামের আশা হয়ে।