গাজায় গণহত্যার ভিডিও দিয়ে ‘অস্ত্রের বিজ্ঞাপন’ দিচ্ছে ইসরায়েলি কোম্পানি

Bangla Post Desk
বাংলা পোস্ট ডেস্ক
প্রকাশিত:১৫ জুলাই ২০২৫, ০৭:৪০ পিএম
গাজায় গণহত্যার ভিডিও দিয়ে ‘অস্ত্রের বিজ্ঞাপন’ দিচ্ছে ইসরায়েলি কোম্পানি

গাজায় নৃশংসতা ও বর্বরতার সব সীমাই একেক করে অতিক্রম করে চলেছে ইসরায়েল। প্রতিনিয়ত বর্বরতার নিত্যনতুন নজির স্থাপন করছে তারা। এরই মধ্যে গাজায় গণহত্যার ভিডিও দিয়ে অস্ত্রের বিজ্ঞাপন দিয়েছে ইসরায়েলের রাষ্ট্রায়ত্ত অস্ত্র প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান রাফায়েল।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আইয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে একটি ভিডিও পোস্ট করে রাফায়েল কর্তৃপক্ষ। ভিডিওতে রাফায়েলের ড্রোন সিস্টেম ‘স্পাইক ফায়ারফ্লাই’কে গাজায় একজন মানুষকে শনাক্ত করে হত্যা করতে দেখা যায়।

স্পাইক ফায়ারফ্লাই ড্রোনের দুই বছর পূর্তিতে ওই ভিডিও পোস্ট করা হয়। সেখানে রাফায়েল কর্তৃপক্ষের দাবি, স্পাইক ফায়ারফ্লাই ড্রোনটি কৌশলগত বাহিনীর জন্য নির্ভুলতার এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। এটি পরীক্ষিত, বিশ্বস্ত ও কৌশলগত।

ভিডিওতে দেখা যায়, একটি ক্ষুদ্রাকৃতির আত্মঘাতী ড্রোন ধ্বংসস্তূপে পরিণত গাজার কিছু জায়গার ওপর মৃদু শব্দে ভেসে বেড়াচ্ছে। এরপর রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকা এক ব্যক্তিকে শনাক্ত করে এবং তাকে লক্ষ্য করে হামলা চালায়।

ভিডিওটির শিরোনাম দেওয়া হয়েছে, ‘স্পাইক ফায়ারফ্লাই ইন আরবান ওয়ারফেয়ার’ অর্থাৎ যুদ্ধ-এলাকায় স্পাইক ফায়ারফ্লাই। এমনকি ভিডিওটির সঙ্গে নাটকীয় ও সামরিক ঘরানার নেপথ্যসুরও যুক্ত করা হয়েছে।

ভিডিওর ওপর লেখা বার্তায় বলা হয়, ‘ড্রোনটি লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত করে, তাকে অনুসরণ করে এবং হুমকি নিষ্ক্রিয় করে।’

ভিডিওতে দেখা যায়, ফায়ারফ্লাই ড্রোনটি নীরবভাবে ভাসতে ভাসতে লক্ষ্যবস্তুর ওপর নেমে আসে। যে ব্যক্তিকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে, ড্রোনটিকে দেখে সে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তখনই বিস্ফোরণ ঘটে।

ভিডিওতে আক্রমণের শিকার ব্যক্তিকে নিরস্ত্র দেখা যায়। তিনি রাস্তা দিয়ে একাই হাঁটছিলেন। তাছাড়া কাউকে হুমকি দিচ্ছেন এমন কোনো প্রমাণও দেখা যায়নি। ফলে ওই ব্যক্তি ফিলিস্তিনি যোদ্ধা কিনা তা স্পষ্ট নয়।

ভিডিওটি গাজার উত্তরাঞ্চলের আল-তাওয়াম এলাকায় ধারণ করা বলে চিহ্নিত করেছেন ওপেন সোর্স বিশ্লেষক আনো নিমো।

নিমো বলেন, ‘দুটি গুগল আর্থ স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ভিডিওটি গত বছরের ৪ জুন থেকে ১ ডিসেম্বরের মধ্যে ধারণ করা হয়েছে।’

তিনি আরও জানান, ২০২৪ সালের নভেম্বরের সেন্টিনেল স্যাটেলাইট চিত্রেও ওই এলাকায় কিছু পরিবর্তনের চিহ্ন রয়েছে।

ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে রাফায়েল কর্তৃপক্ষ জানায়, ফায়ারফ্লাই ড্রোনটি খুবই সামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রেখে জিপিএস জ্যামিং ও প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যেও নির্ভুল হামলা করেছে। এর মাধ্যমে সবচেয়ে কঠিন পরিবেশেও নিজেকে প্রমাণ করেছে ফায়ারফ্লাই।

ড্রোনটি মূলত স্থল বাহিনীর জন্য ডিজাইন করা হয়েছিল। ঘনবসতিপূর্ণ শহুরে এলাকায় যেখানে পরিস্থিতি বোঝা কঠিন, শত্রুরা আড়াল থেকে যুদ্ধ করছে এবং বেসামরিকদের উপস্থিতির কারণে গোলাবর্ষণ সীমিত, সেখানে নিরাপদে অপারেশন চালানোর জন্য এটি তৈরি করা হয়েছিল।

তবে রাফায়েলের ভিডিওতে দেখানো ঘটনার ক্ষেত্রে উপরের কোনো শর্তই প্রযোজ্য নয়। এই ড্রোনটি একজন সৈনিক তাৎক্ষণিকভাবে (রিয়েল-টাইমে) নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন বলে জানানো হয়েছে।

রাফায়েল অ্যাডভান্সড ডিফেন্স সিস্টেমসের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও প্রতিবেদনটি প্রকাশের সময় পর্যন্ত (১৪ জুলাই বাংলাদেশ সময় দুপুর আড়াইটা) মিডল ইস্ট আইকে তারা কোনো মন্তব্য দেয়নি বলে খবরে বলা হয়েছে।

ইসরায়েলি অস্ত্র বিজ্ঞাপন

ইসরায়েল এখন পর্যন্ত অন্তত ১৩০টি দেশের কাছে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করেছে এবং বর্তমানে বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ।

অধিকৃত পশ্চিম তীর ও গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর ব্যবহৃত অস্ত্র ও প্রযুক্তিকে ‘মাঠে পরীক্ষিত’ হিসেবে বাজারজাত করে ইসরায়েলি কোম্পানিগুলো। রাফায়েলের ভিডিওটিও সেই বিজ্ঞাপন কৌশলেরই একটি উদাহরণ।

রাফায়েল ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের সায়েন্স কর্পস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠানটি এখন সবচেয়ে বেশি পরিচিত আয়রন ডোম (ইসরায়েলি বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা) এবং গাইডেড মিসাইল তৈরির জন্য।

এই অস্ত্র কোম্পানিটির বাজারজাতকরণে অতীতেও ব্যতিক্রমী কৌশলের নজির রয়েছে। ২০০৯ সালে ভারতের জন্য এক বলিউড-স্টাইলের মিউজিক ভিডিও প্রকাশ করেছিল রাফায়েল। সেখানে চশমা ও চামড়ার জ্যাকেট পরিহিত এক ব্যক্তি ইসরায়েলের এবং একটি হাতের কারুকাজ করা শাড়ি পরা নারী ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন।

ভিডিওতে তারা একে অপরের প্রতি প্রেমের গান গেয়ে ওঠেন। সেই সময় চারপাশে নাচতে শুরু করেন ভারতীয় নারীরা। ওই নারী গানে গানে বলেন, ‘আমার নিরাপত্তা ও সুরক্ষা দরকার। আমি তোমায় বিশ্বাস করি।’ জবাবে ইসরায়েলের প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তি বলেন, ‘তুমি আমায় বিশ্বাস কর।’

এরপর তারা সম্মিলিতভাবে গান গায়, ‘একসঙ্গে, চিরকাল, আমরা এক থাকব।’

এই ভিডিওটি ধারণের পর ইউটিউবে পোস্ট করেছিলেন রনি ডানা। তিনি জানান, ইসরায়েলে বিতর্ক সৃষ্টির পরও এই ভিডিওটি বেশ সফল হয় এবং কয়েক বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র চুক্তিতে অবদান রাখে।

রাফায়েলের ‘যুদ্ধাপরাধ’

গতবছর অস্ত্র বিক্রি করে ৪৮০ কোটি ডলার আয় করেছে রাফায়ের কোম্পানি, যা আগের বছরের তুলনায় ২৭ শতাংশ বেশি। কোম্পানিটি জানিয়েছে, এই আয়ের প্রায় অর্ধেক এসেছে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কাছ থেকে, যার মধ্যে ২০টি ন্যাটোভু্ক্ত সদস্য রাষ্ট্রও রয়েছে।

রাফায়েল উত্তর ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় নিয়োগকারী অস্ত্র কোম্পানি এবং যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ভারতসহ তাদের মোট ১০টি দেশে কার্যালয় রয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভারত সরকারের এক উপদেষ্টা গাজার ভিডিওতে ড্রোনের মাধ্যমে একজন ব্যক্তিকে টার্গেট করার ঘটনাকে ‘যুদ্ধাপরাধ’ বলে অভিহিত করেছেন।

লন্ডনের এসওএএস বিশ্ববিদ্যালয়ের গণআইন বিভাগের ফিলিস্তিনি অধ্যাপক নিমের সুলতানি মিডল ইস্ট আইকে বলেন, ‘হ্যাঁ, এটি স্পষ্টতই একটি যুদ্ধাপরাধ। একজন নিরস্ত্র, রাস্তায় হাঁটতে থাকা, সামরিক কার্যক্রমে জড়িত না থাকা ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছে।’

তিনি জানান, জেনেভা কনভেনশনের চতুর্থ অনুচ্ছেদের তৃতীয় ধারা অনুযায়ী, যেসব ব্যক্তি সক্রিয়ভাবে শত্রুতায় অংশ নিচ্ছেন না, তাদের সব অবস্থায় পার্থক্য না করে মানবিকভাবে আচরণ করতে হবে।’

আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের রোম সংবিধান অনুযায়ী, যেসব হামলা বেসামরিক জনগণের ওপর করা হয়, যারা সরাসরি লড়াইয়ে অংশ নিচ্ছেন না, সেগুলোকে ইচ্ছাকৃত হামলা হিসেবে যুদ্ধাপরাধ ধরা হয়।

সুলতানি বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে, এসব হত্যাকাণ্ড গণহত্যার অংশ। তাই এগুলো গণহত্যামূলক হত্যাকাণ্ড।’

গাজায় ইসরায়েলের চালানো সামরিক অভিযানে ভবনের ভেতরে থাকা ব্যক্তিদের লক্ষ্য করে বিমান ও স্থল হামলায় রাফায়েলের স্পাইক গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র বহুলভাবে ব্যবহার করা হয়েছে।

রাফায়েলের সহযোগী প্রতিষ্ঠান অ্যারোনটিক্সের তৈরি ড্রোন ‘অর্বিটার ৪’ প্রথমবারের মতো ২০২৩ সালের ৮ নভেম্বর গাজায় ব্যবহার করা হয়।

২০২৫ সালের মার্চে রাফায়েলের মার্কিন সহযোগী প্রতিষ্ঠান রাফায়েল সিস্টেমস গ্লোবাল সাসটেইনমেন্ট ঘোষণা দেয়, তারা মার্কিন সেনাবাহিনীর সঙ্গে একটি সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যেখানে স্পাইক ক্ষেপণাস্ত্র পরিবারের যৌথ উন্নয়ন এবং এর ‘ভবিষ্যৎ উন্নয়ন ও আমেরিকানাইজেশন’ নিশ্চিত করার জন্য একসঙ্গে কাজ করার কথা বলা হয়।