গদি রক্ষায় পাখির মতো মানুষ মারছে নেতানিয়াহু?

Bangla Post Desk
বাংলা পোস্ট ডেস্ক
প্রকাশিত:২০ মার্চ ২০২৫, ০৩:১৯ পিএম
গদি রক্ষায় পাখির মতো মানুষ মারছে নেতানিয়াহু?

গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপ কার্যকর হওয়া নিয়ে টানাপোড়েন চলছিল বেশ কিছুদিন ধরেই। দুইপক্ষ শর্তারোপ করে যাচ্ছিল নিজেদের মতো করে। কিন্তু সবকিছু উড়িয়ে দিয়ে মঙ্গলবার (১৮ মার্চ) সেহরির সময় নতুন করে আগ্রাসন শুরু করে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। এতে নারী-শিশুসহ চার শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হন।

দ্বিতীয় দিনেও জাতিসংঘের এক কর্মকর্তাসহ ২০ ফিলিস্তিনির প্রাণহানি ঘটেছে। গাজায় এখনো ইসরায়েলের সামরিক হামলা অব্যাহত রয়েছে। বিশ্লেষকদের অভিযোগ, গদি রক্ষায় পাখির মতো মানুষ হত্যায় মেতে উঠেছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।

এই হামলার মধ্য দিয়ে নেতানিয়াহু যুদ্ধবিরতি চুক্তি থেকে বের হয়ে গেছেন বলে দাবি করছেন বিশেষজ্ঞরা। ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসকে গুঁড়িয়ে দিতে এই বিমান হামলা বলে দাবি করছেন তিনি। তবে এতে হামাসের হাতে থাকা ইসরায়েলিদের জীবন সংকটে পড়তে পারে বলে শঙ্কা করা হচ্ছে।-খবর অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি)।

হামাসও সেই হুমকি দিয়ে রেখেছে। বলেছে, ইসরায়েলের বোমা শুধু ফিলিস্তিনিদের নয়, তাদের হাতে জিম্মি ইসরায়েলিদের জীবনও হুমকিতে ফেলবে।

সবকিছু জেনেশুনে নেতানিয়াহু কেন এই হামলা শুরু করল, তা নিয়ে স্বভাবতই উঠেছে প্রশ্ন। এর জবাব পেতে হলে খোঁজ নিতে হবে ইসরায়েলি প্রশাসনের ভেতর থেকে। মূলত ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আকস্মিক হামলার পর থেকে নিজ দেশে দুটি পরস্পর বিপরীত মতের সম্মুখীন হয়েছে নেতানিয়াহু। 

একদিকে, হামাসের হাতে জিম্মিদের পরিবারগুলো চাচ্ছেন নেতানিয়াহু যেন একটি চুক্তি করে বন্দিদের ফিরিয়ে আনে। অন্যদিকে, নেতানিয়াহুর জোট সরকারের কট্টর ডানপন্থি নেতাদের কাছ থেকে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার চাপ রয়েছে। তারা যেকোনো মূল্যে হামাসের নির্মূল চান। 

ফিলিস্তিনিদের জীবনের প্রতি মায়া তো নেতানিয়াহুর দর্শনে নেই। এবার নিজ দেশের নাগরিকদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে তিনি বেছে নিয়েছেন দ্বিতীয় পথ। ফলে মন্ত্রিসভার ভোটে আস্থা অটুট রেখে টিকে থাকবে তার গদি—এমনই ধারণা অনেক বিশ্লেষকের।

লক্ষণীয় হচ্ছে, এ দফার হামলাতে মদত দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্পের নির্দেশেই নেতানিয়াহু ফের যুদ্ধ শুরু করেছেন বলে নিশ্চিত করেছেন হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র ক্যারোলিন লেভিট। অথচ এই যুক্তরাষ্ট্র ১৯ জানুয়ারি কার্যকর হওয়া যুদ্ধবিরতির অন্যতম মধ্যস্থতাকারী হিসেবে দাবি করে নিজেদের। 

হামাস জিম্মিদের মুক্তি দিতে সম্মত না-হওয়ায় এ দফায় হামলা চালানো হয়েছে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল। তেল-আবিব আরও দাবি করে, হামাস ফের সংগঠিত হয়ে হামলার পরিকল্পনা করছিল। তবে নিজেদের বক্তব্যের সমর্থনে ন্যূনতম কোনো প্রমাণও দেখাতে পারেনি তারা। 

এই অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করেছে হামাস। গত সপ্তাহে যুদ্ধবিরতির আলোচনা এগিয়ে নিতে নানা তৎপরতা চালিয়েছে তারা। প্রথম ধাপের যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়িয়ে জিম্মিদের মুক্ত করতে চাইছিল ইসরায়েল। 

সংগঠনটির সদস্যরাও জানিয়েছে, তারা অবশ্যই ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তি দেবেন। তবে তা কেবল যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপে। যেখানে মুক্তি পাবেন ইসরায়েলের কারাগারে থাকা ফিলিস্তিনি বন্দিরা। এছাড়াও হামাসের দাবি একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতি ও গাজা থেকে ইসরায়েলের সেনাপ্রত্যাহার। 

যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রথম থেকে পরস্পরকে নানা কারণে দোষারোপ করে আসছিল ইসরায়ের ও হামাস। তা সত্ত্বেও ১৯ জানুয়ারি প্রথম ধাপ কার্যকর হয়েছিল। এ ধাপে ৩৩ জন ইসরায়েলি জিম্মিকে ফিরিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে আটক কয়েকশ ফিলিস্তিনি বন্দি মুক্তি পেয়েছেন।

বন্দিবিনিময় চলাকালে পাল্টাপাল্টি অভিযোগে বারবার চুক্তি ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। কোনোভাবে সেটি শেষ হলেও এগোয়নি দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা। আর এগোবে বলেও কোনো সম্ভাবনা নেই বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

কারণ, গত জুনে এক টেলিভিশন সাক্ষাতকারে নেতানিয়াহু বলেছিল, ‘যুদ্ধবিরতি থাকলেও হামাসকে নির্মূল করতে আমরা হামলা চালাতে বদ্ধপরিকর। এ বিষয়ে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।’

এমনকি ১৮ জানুয়ারি যুদ্ধবিরতির ঠিক আগমুহূর্তেও বলেছিল, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে যেকোনো সময়ে আমাদের যুদ্ধে ফেরার অধিকার রয়েছে।’ তবে কে তাকে নিষ্পাপ নারী-শিশু ও অগণিত ফিলিস্তিনিকে ‘হামাস নির্মূলের অজুহাতে’ হত্যা করার অধিকার দিয়েছে, সেই ব্যাখ্যা মেলেনি তার কাছ থেকে।

গদি রক্ষায় পাখির মতো মানুষ মারছে নেতানিয়াহু?

গদি বাঁচালেন নেতানিয়াহু

নেতানিয়াহু নিজ রাজনৈতিক স্বার্থে এই গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তিনি যদি হামাসের সঙ্গে স্থায়ী কোনো যুদ্ধবিরতির চুক্তিতে সম্মত হন, তাহলে নিশ্চিতভাবে রাজনৈতিক সংকটে পড়তে পারেন।

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী দ্বিতীয় ধাপের যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হলে জোট থেকে বের হয়ে যাওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন কট্টর ডানপন্থি নেতা ও অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোত্রিচ। এর আগে জানুয়ারিতে প্রথম ধাপের যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ায় জোট থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন জোটের আরেক কট্টর ডানপন্থি নেতা ইতামার বেন গাভীর। 

এ অবস্থায় স্মোত্রিচও যদি বের হয়ে যেতেন নেতানিয়াহুর জোট দুর্বল হয়ে পড়ত। ফলে বিরোধীদের চাপে আগাম নির্বাচন দিতে হত তাকে, এতে নিজের গদি হারানোর শঙ্কা প্রবল হয়ে উঠেছিল। তা কি করে হতে দেয় নেতানিয়াহু!

মঙ্গলবার (১৮ মার্চ) নেতানিয়াহু ফের হামলা শুরু করায় স্মোত্রিচের সমর্থনও তার রইল, আবার ইতামারও ফিরেছেন জোটে। এছাড়া তিনি বারবার হামাস ধ্বংস করার যে ঘোষণা দিয়েছেন, তা-ও তিনি পূরণ করতে পারতেন না, এ কারণেই বীভৎস এই হামলা আবার শুরু করেন বলে ধারণা করছেন অনেকে। 

যুক্তরাষ্ট্র কি বলছে

১৯ জানুয়ারি যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর হওয়ার পর কৃতিত্ব নেওয়া প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজের সুর বদলে ফেলেছেন। জিম্মিদের মুক্তি না দিলে গাজাকে নরক করে তোলার হুমকি দেন তিনি। 

শুধু তাই নয়; গাজাবাসীদের উৎখাত করে তাদের জন্মভূমি দখলও করতে চেয়েছেন তিনি। এরপর সত্যিই গাজাকে নরক বানাতে ইসরায়েলের হামলায় সমর্থন দেয় যুক্তরাষ্ট্র।

ফলে ১৫ মাসের সহিংসতা শেষে যুদ্ধবিরতি চলায় প্রাণশঙ্কা একপাশে রেখে পরিবার নিয়ে ভোর রাতে সেহরি খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল গাজার বাসিন্দারা, তখনই মুহুর্মুহু বোমা বর্ষণে কেঁপে ওঠে উপত্যকা। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর (আইডিএফ) হামলা থেকে আবাসিক ভবন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে শরণার্থী শিবির—কিছুই রেহাই পায়নি।

এ অবধি হামলায় নিহত হয়েছেন কয়েক শত মানুষ, যাদের মধ্যে অধিকাংশই নারী ও শিশু। যতদিন প্রয়োজন, ততদিন হামলা চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ইসরায়েল। এতে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন আছে বলেও নিশ্চিত করেছে তেল আবিব।