ভিমরুলের কামড় কতটা ভয়ংকর? সাবধানতা ও করণীয়
বিষাক্ত পোকামাকড়ের উপদ্রব মানুষের বসবাসের পরিবেশকে অনায়াসেই প্রতিকূল করে তোলে। বোলতা ও মৌমাছির মতো কীটপতঙ্গগুলোর হুল ফোটানো বা কামড় থেকে প্রচণ্ড ব্যথা, এমনকি সংক্রমণের দিকে নিয়ে যেতে পারে। একসঙ্গে অনেকগুলোর আক্রমণ প্রাণঘাতী হতে পারে। যাদের পতঙ্গ নিয়ে গুরুতর অ্যালার্জি রয়েছে তাদের জন্য দু-একটির কামড়ই মারাত্মক হুমকির কারণ হতে পারে। তবে এই বিষাক্ত পতঙ্গগুলোর মধ্যে আক্রমণাত্মক প্রকৃতি ও বিষের ভয়াবহতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে ভিমরুল। চলুন, বিষাক্ত পতঙ্গ ভিমরুল থেকে নিরাপদ থাকার উপায় এবং আক্রান্ত হলে তাৎক্ষণিকভাবে করণীয় সম্বন্ধে জেনে নেওয়া যাক।
ভিমরুল কতটা বিপজ্জনক
মূলত বৈশিষ্ট্যগত কারণে ভিমরুলের ভয়াবহতা অন্য সব কীটপতঙ্গ থেকে বেশি। এই বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে আকার-আকৃতি, একাধিকবার কামড়ানোর প্রবণতা, প্রতি কামড়ে নির্গত বিষের তীব্রতা এবং তাতে স্বাস্থ্য ঝুঁকি। চলুন, এই বিষয়গুলো আরও গভীরভাবে পর্যালোচনা করা যাক।
ভিমরুল কেন অন্যান্য বিষাক্ত পোকামাকড় থেকেও বিপজ্জনক
প্রায় সময় বোলতার সঙ্গে মিলিয়ে ফেলা হলেও ভিমরুল একটি স্বতন্ত্র প্রজাতি। এরা বোলতার সমগোত্রের; তবে আকারের দিক থেকে এগুলো অপেক্ষাকৃত বড় হয়ে থাকে। এগুলো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলকে আঁকড়ে পড়ে থাকে। নিজেদের আবাস বাঁচানোর ক্ষেত্রে এরা ভয়ংকর রকম রক্ষণাত্মক হয়। যার কারণে যেকোনো পরিস্থিতে হুমকি অনুভব করলে সঙ্গে সঙ্গে শিকারের প্রতি ঝাঁকে ঝাঁকে আক্রমণ চালায়। এতে শিকারের শরীরে বেশ অল্প সময়ের মধ্যেই অসংখ্য হুল ফোটে।
সমগোত্রের অন্যান্য কীটপতঙ্গের হুল ফোটানো বা কামড়ানোর ক্ষেত্রে বৈশিষ্ট্যগত সীমাবদ্ধতা থাকে। তাই শুধু প্রাণনাশের হুমকি থাকলেই সেগুলো মরিয়া হয়ে আক্রমণ করে। কিন্তু ভিমরুলে এমন কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। কোনো রকম শারীরিক প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই এগুলো একের পর এক হুল ফোটাতে পারে। এমনকি এই আক্রমণাত্মক ভঙ্গিমার জন্য অত্যন্ত নগণ্য কারণই যথেষ্ট।
ভিমরুলের কামড়ে বিষের তীব্রতা
যে ধরনের পোকামাকড় হুলের মাধ্যমে বিষ ছড়ায়, সেগুলোর মধ্যে ভিমরুলের বিষের শক্তি সর্বাপেক্ষা বেশি। এগুলোর বিষে অ্যাসিটাইলকোলিনসহ বিষাক্ত কিছু পদার্থের মিশ্রণ থাকে। একটি ভিমরুল কামড়ের ফলে মানুষের দেহে ২ থেকে ৩ মিলিগ্রাম বিষ প্রবেশ করে। সাধারণত মানবদেহের প্রতি কেজি ওজনে ১০ মিলিগ্রাম বিষ ঢুকলে মানুষের মৃত্যু ঘটাতে পারে। অর্থাৎ ৬০ কেজি ওজনের সুস্থ একজন ব্যক্তির দেহে ৬০০ মিলিগ্রাম বিষ প্রবেশ করলেই তার মৃত্যু হবে। আর বলাই বাহুল্য যে, একটি ভিমরুল শুধু একবার হুল ফুটিয়েই ক্ষান্ত হয় না।
ভিমরুলের কামড়ে স্বাস্থ্য ঝুঁকি
অ্যাসিটাইলকোলিনসহ বিষাক্ত পদার্থ শরীরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে তীব্র ব্যথার সৃষ্টি হয়। তাৎক্ষণিকভাবেই কামড়ের স্থানটি ফুলে গিয়ে লাল বর্ণ ধারণ করে। তারপর ধীরে ধীরে সেখানে চুলকানি বাড়তে থাকে। এভাবে একে একে বমি বমি ভাব, মাথা ঘোরা, অতঃপর কিডনি বা লিভারের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে সারা দেহ ক্রমশ অবনতির দিকে এগোতে থাকে।
যাদের অ্যালার্জি আছে তাদের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যের এই অবনতি আরও দ্রুততর হয়। চিকিৎসা শাস্ত্রে এই অবস্থা অ্যানাফিল্যাক্সিস নামে পরিচিত। এতে শ্বাসনালী ফুলে যেতে পারে, শ্বাসকষ্ট হতে পারে এবং রক্তচাপ দ্রুত হ্রাস পেতে পারে। অ্যানাফিল্যাক্সিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মৃত্যুর আশঙ্কা বেশি থাকে।
ভিমরুলের কামড় থেকে নিরাপদ থাকার উপায়
ভিমরুলের আবাসস্থলগুলো এড়িয়ে চলা
সাধারণত গাছের ডালে এই পতঙ্গের বসতি বেশি দেখা যায়। এছাড়াও দালানের বাইরের দেওয়ালে সানশেডে, টালি দেওয়া ছাতের ফাঁকে এরা বাসা করে। গ্রীষ্মের শেষের দিকে এবং শরতের প্রথম দিকে এরা সংখ্যায় বেশি থাকে। সেই সঙ্গে এই মৌসুমগুলোতে বেশ সক্রিয়ও থাকে এরা। এই সময়ে বাড়ির আশেপাশে এদের আবাসস্থলের উপস্থিতি টের পেলেই সাবধান হয়ে যাওয়া উচিত।
উজ্জ্বল রঙের পরিধেয় এবং কড়া সুগন্ধি ব্যবহার না করা
ভিমরুল উজ্জ্বল রঙ বিশেষ করে হলুদ রঙ এবং কড়া সুগন্ধির প্রতি আকৃষ্ট হয়। এছাড়া মৌমাছির মতো এরাও অমৃতের জন্য ফুলের দিকে ধাবিত হয়। তাই ঘরের ভেতর বাগান থাকাটাও বিপজ্জনক। উপরন্তু, পারফিউম, কোলোন বা সুগন্ধি লোশনের তীব্র ঘ্রাণ শুঁকে ভিমরুল কাছাকাছি চলে আসতে পারে। ঠিক একই কারণে খাবারের মিষ্টি গন্ধও এদের আকৃষ্ট করে। তাই পরিধানের ক্ষেত্রে সাদা বা হাল্কা রঙ এবং ব্যবহারের জন্য হাল্কা সুগন্ধি বেছে নেওয়া উচিত।
খাবার ও পানীয় ঢেকে রাখা
মিষ্টি গন্ধ যেন চারপাশ ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য খাবার বা পানীয় ঢেকে রাখা জরুরি। বিশেষ করে বাইরে খোলা আকাশের নিচে ভোজের সময় এই বিষয়টি খেয়াল রাখা দরকার। এক্ষেত্রে সিল করা পাত্র ব্যবহার করা উত্তম। আর খাওয়া শেষে অবশ্যই সেগুলো ডাস্টবিনে ফেলে তার ওপর ঢাকনা লাগিয়ে দিতে হবে। এর জন্য কোনোভাবেই উন্মুক্ত ডাস্টবিন ব্যবহার করা সমীচীন নয়।
প্রতিরক্ষামূলক পোশাক পরিধান করা
বাগান বা পার্কের মতো স্থানে বিচরণের সময় প্রতিরক্ষামূলক পোশাক পরা আবশ্যক। লম্বা হাতার শার্ট, লম্বা প্যান্ট, গ্লাভ্স ও ক্যাপ প্রভৃতির মাধ্যমে শরীরের ত্বক তুলনামূলকভাবে কম উন্মুক্ত হয়।
এগুলো ভিমরুল দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমাতে পারে। উষ্ণ আবহাওয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে হাল্কা ঢিলেঢালা কাপড় বেছে নেওয়া যেতে পারে। এমনকি জুতা পরার ক্ষেত্রেও কেডসের মতো পুরো পা ঢেকে রাখে এমন কিছু জুতাগুলো পড়া উচিত।
প্রাকৃতিক প্রতিরোধক ব্যবহার করা
সিট্রোনেলা, ইউক্যালিপ্টাস ও পেপারমিন্টের তেলগুলোতে ভিমরুল প্রতিরোধী বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এগুলো পানির সঙ্গে মিশিয়ে বাড়ির আঙিনা বা বাগানে স্প্রে করা যায়। চিলেকোঠা, স্টোর রুম, বা বাইরের সিঁড়ি ঘরে সিট্রোনেলা মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখলে তা ভিমরুলকে দূরে রাখতে পারে।
বাড়ির আশেপাশে ভিমরুলের বসতি ধ্বংস করা
ভিমরুলের উপদ্রব থেকে বাঁচার সর্বোত্তম পন্থা হলো তাদের সমূলে উৎপাটন করা। এর জন্য বাড়ির আঙ্গিনায় মিষ্টি টোপ দিয়ে ফাঁদ তৈরি করতে হবে। ফাঁদগুলো জনাকীর্ণ স্থান থেকে যথেষ্ট দূরে রাখা উচিত। অন্যথায় কোলাহলপূর্ণ জায়গায় ফাঁদ পাতা মানে উল্টো মানুষকে কামড়ানোর আশঙ্কা বাড়ে। এর জন্য বসন্তের প্রথম দিকের মাসগুলোকে বেছে নেওয়া যায়। কারণ এ সময় ভিমরুল সংখ্যা সবেমাত্র বাড়তে শুরু করে।
ভিমরুল কামড়ালে করণীয়
দ্রুত নিরাপদ দূরত্বে সরে পড়া
ভিমরুল কামড়ানোর পর সঙ্গে সঙ্গেই প্রাণঘাতী পতঙ্গগুলোর কাছ থেকে দূরে সরে পড়তে হবে। অন্যথায় একাধিক কামড় খাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাছাড়া আশেপাশে ভিমরুলের বাসা থাকতে পারে। সেখান থেকে আরও ভিমরুল আক্রমণ চালাতে পারে।
মূলত একবার কামড়ানোর পর ভিমরুলের শরীর থেকে ফেরোমোন নিঃসৃত হয়। এই রাসায়নিক শিকারের ব্যাপারে অন্যান্য ভিমরুলদের জানান দেয়। ফলে তারাও আক্রমণ করতে উদ্দত হয়।
ক্ষত স্থান পরিষ্কার করে তাতে ঠান্ডা কম্প্রেস লাগানো
সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে সাবান ও পানি দিয়ে ক্ষত স্থানটি ভালোভাবে পরিষ্কার করে নিতে হবে। অতঃপর একটি ঠান্ডা কম্প্রেস বা কয়েকটি বরফ টুকরা একটি কাপড়ে পেঁচিয়ে জায়গাটিতে চেপে ধরতে হবে। এই শীতল পরশ ফোলাভাব কমাতে সাহায্য করবে, ব্যথা উপশম করবে এবং বিষের বিস্তার রোধে সহায়তা করবে।
ব্যথা উপশমকারী ব্যবহার
তাৎক্ষণিকভাবে ব্যথা কমানোর জন্য কিছু ঘরোয়া উপায় রয়েছে। যেমন কয়েক ফোঁটা ল্যাভেন্ডার তেল, তুলসি পাতার রস, অ্যালোভেরা জেল, ইউক্যালিপ্টাস তেল প্রভৃতি ক্ষত স্থানে লাগানো যেতে পারে। এগুলোতে থাকা প্রদাহবিরোধী উপাদান ব্যথা, জ্বালাভাব, চুলকানি, ও ফোলা অবস্থা কমাতে সাহায্য করে।
এছাড়া অ্যাপেল সিডার ভিনেগার ও বেকিং সোডার মিশ্রিত পেস্ট ব্যবহার করা যায়। ভিনেগারে সাধারণত বিষের অ্যাসিড নিষ্ক্রিয় করার ক্ষমতা থাকে। শুধু ভিনেগার তুলোয় ভিজিয়েও আক্রান্ত স্থানে আলতো করে বুলিয়ে দেওয়া যায়।
ফোলা ভাব ও ব্যথা কমাতে কার্যকর একটি ওষুধ হচ্ছে অ্যান্টিহিস্টামিন বা আইবুপ্রোফেন। তবে ব্যবহারের আগে ঠিক কতটুকু ডোজ ব্যবহার করতে হবে সে ব্যাপারে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
আক্রান্ত স্থান উঁচু করে রাখা
হাতে বা পায়ে কামড়ালে বিষ যেন সারা দেহে ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্য ক্ষত স্থানযুক্ত অঙ্গটিকে উঁচু করে ধরতে হবে। এতে আক্রান্ত জায়গাটির অভ্যন্তর ভাগে বিষ জমাট বাঁধার গতি কমে গিয়ে ফুলে যাওয়ার তীব্রতা হ্রাস পায়। একই সঙ্গে উঁচু করে রাখলে অঙ্গটিতে রক্ত সঞ্চালন বাড়ে, যা নিরাময় প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে।
যত দ্রুত সম্ভব ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হওয়া
গুরুতর প্রভাবগুলো সাধারণ মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব হয় না। যেমন অ্যানাফিল্যাক্সিসের লক্ষণগুলো কেবল একজন বিশেষজ্ঞই ধরতে পারেন। এ অবস্থায় তাৎক্ষণিকভাবে এপিনেফ্রিন অটো-ইনজেক্টর (এপিপেন) ব্যবহারের প্রয়োজন পড়তে পারে।
তাছাড়া অ্যালার্জি না থাকলেও যাদের শরীরে একাধিক হুল ফুটেছে তাদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরণের স্বাস্থ্য জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাই অবিলম্বে আক্রান্ত ব্যক্তিকে নিকটস্থ চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া অপরিহার্য।
পরিশিষ্ট
ভিমরুলের কামড়ে তীব্র ব্যথা ও ফুলে যাওয়া থেকে শুরু করে চূড়ান্ত পর্যায়ে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এই বিষাক্ত পতঙ্গ থেকে নিরাপদে থাকতে এগুলোর আবাসস্থল থেকে দূরে থাকা এবং প্রয়োজনে এগুলোর বাসা ধ্বংস করা জরুরি। উজ্জ্বল রঙের পোশাক পরিধান বা কড়া সুগন্ধি মাখা ত্যাগ করা এবং খাবার ও পানীয় ঢেকে রাখা উচিত। কেননা উজ্জ্বল রঙ ও কড়া গন্ধের মাধ্যমে ভিমরুল আকৃষ্ট হয়। ভিমরুল দ্বারা আক্রান্ত হলে কামড়ের স্থানটি পরিষ্কার করা, এবং সর্বাত্মক ভাবে জায়গাটি ঠাণ্ডা রাখা দরকার। এ অবস্থায় নানা রকম স্বাস্থ্য জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে, তাই অনতিবিলম্বে আক্রান্ত ব্যক্তিকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা প্রদান আবশ্যক।