চোখের আলো নেই শামীমের, তবু ৫ হাজার মোবাইল নম্বর মুখস্থ


নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার নিজ সুন্দরখাতা গ্রামের বাসিন্দা শামীম ইসলাম (২৬)। জন্ম থেকেই চোখে আলো নেই, তবু তাঁকে ঘিরে আছে আলো ছড়ানোর গল্প। চোখে দেখতে না পেলেও কেবল শুনে ও মনে রাখার ক্ষমতায় তিনি অবাক করে দিয়েছেন সবাইকে।
শামীমের বয়স যখন মাত্র পাঁচ মাস, তখন হঠাৎ টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হন। অসচেতনতার কারণে চিকিৎসকের কাছে নেওয়া হয়নি। গ্রামের পল্লি চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসায় চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায় তাঁর দৃষ্টি। সেই থেকেই নেমে আসে জীবনের অন্ধকার। কিন্তু সেই অন্ধকারকে জীবনের শেষ হিসেবে দেখেননি শামীম। বরং দৃষ্টিশক্তির পরিবর্তে শ্রবণশক্তি ও স্মৃতিশক্তিকেই বানিয়েছেন নিজের আলোর পথ।
শামীমের অসাধারণ স্মৃতিশক্তির কথা এখন গ্রামজুড়ে গল্প। একবার কোনো মোবাইল নম্বর শুনলেই তিনি মনে রাখতে পারেন। গ্রামবাসীর দাবি, এখন পর্যন্ত তিনি ৫ হাজারেরও বেশি নম্বর মুখস্থ করে রেখেছেন।
স্থানীয় যুবক মিরাজ হোসেন বলেন, ‘আমরা অনেকে এক সপ্তাহে নিজের আত্মীয়ের নম্বরই ভুলে যাই, কিন্তু শামীম একবার শুনলেই বলে দিতে পারে কার নম্বর। আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি, বছরখানেক পরেও ও ঠিক ঠিক বলে দিয়েছে। এটা আমাদের কাছে এক বিস্ময়।’
শামীমের স্মৃতিশক্তি শুধু নম্বরেই সীমাবদ্ধ নয়। কেউ একবার কথা বললেই কণ্ঠ শুনে চিনে ফেলেন। এমনকি মোটরসাইকেলের শব্দ শুনেও বলে দিতে পারেন কোন কোম্পানির বাইক।
খগারহাট এলাকার যুবক আব্দুস সামাদ বলেন, ‘একদিন পালসার বাইকে যাচ্ছিলাম। শামীম বলল, এটা তো পালসারের শব্দ। চোখে না দেখেও এমনটা বলা সত্যি অবাক করার মতো।’ সামাদ জানান, শামীম প্রায় সব ধরনের বাইকের শব্দ শুনে নাম বলতে পারে।
গ্রামবাসী রেজিনা বেগম বলেন, ‘ওর চোখে আলো নেই, কিন্তু ওর মনে যে আলো আছে, সেটা আমাদের সবার শেখার মতো। শামীম আমাদের গ্রামের গর্ব।’
শামীম একাই বাজারে যান, নিজের কেনাকাটা নিজেই করেন। এমনকি নীলফামারী ও রংপুরে গিয়েও বাবার ব্যবসার জন্য মালামাল কিনে আনেন।
তাঁর ভাই সুমন ইসলাম বলেন, ‘আমার ভাই নিজের সব কাজ নিজেই করে। আমরা অবাক হয়ে যাই ওর আত্মবিশ্বাস দেখে। বাবার দোকানের মাল আনতেও ও একাই রংপুরে যায়, সব ঠিকঠাক করে ফেরে।’
কিছুদিন তিনি গ্রামের একটি ফ্লেক্সিলোড ও বিকাশের দোকানে কাজ করেছেন। দোকানে কেউ নম্বর বললেই মুহূর্তেই রিচার্জ করে দিতেন। কখনো ভুল হয়নি।
স্থানীয় দোকানদার হাবিবুর রহমান বলেন, ‘ওর মতো আত্মবিশ্বাসী মানুষ খুব কম দেখি। দোকানে এলে টাকার নোটে হাত বুলিয়েই বলে দেয়, ‘এইটা তো ১০০ টাকার নোট।’ ভুল হয় না কখনো। এমনকি নম্বর শুনেই ফোন রিচার্জ করে।’
শামীম দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে বড়। বাবা মিজানুর রহমান বৈদ্যুতিক পাম্প মিস্ত্রির কাজ করেন, মা শেফালী বেগম গৃহিণী।
মা শেফালী বেগম বলেন, ‘ছেলেটা চোখে দেখতে পায় না, কিন্তু আল্লাহ ওর মনে যে শক্তি দিছে, তা আমাদের সবার জন্য দৃষ্টান্ত। একা বাজারে যায়, নিজের কাজ নিজেই করে। আমি মাঝে মাঝে ভয় পাই, কিন্তু ওর সাহসেই বাঁচি।’
বোন লিসামনি বলেন, ‘ওর ভরসা শ্রবণ আর স্মৃতি। আমরা অনেক সময় নির্ভর করি ওর ওপর। শামীম ভাই আমাদের প্রেরণা।’
শামীম বলেন, ‘আমি একবার কারও নাম বা মোবাইল নম্বর শুনলেই মনে রাখতে পারি। কারও কণ্ঠস্বর শুনলে ভুল হয় না। মোটরসাইকেলের শব্দ শুনেই বুঝে ফেলি কোন কোম্পানির বাইক, টাকার নোট হাতে নিলেই বুঝি কত টাকার। চলাফেরা করতে আমার কারও সাহায্যের প্রয়োজন হয় না।’
গ্রামের মানুষের কাছে শামীম এখন এক অনুপ্রেরণার নাম। অন্ধকারে থেকেও যিনি আশার আলো জ্বালাতে শিখিয়েছেন সবাইকে।