বন্ধ হচ্ছে কক্সবাজার সৈকতে লাইফগার্ড সেবা

Bangla Post Desk
বাংলা পোস্ট প্রতিবেদক
প্রকাশিত:২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০১:১৪ পিএম
বন্ধ হচ্ছে কক্সবাজার সৈকতে লাইফগার্ড সেবা

সৈকত ঘিরে কক্সবাজারে পর্যটনের প্রসার ঘটে নব্বইয়ের দশক থেকে। বছরজুড়ে বেলাভূমির নোনাজলের সান্নিধ্যে আসেন প্রায় অর্ধকোটি পর্যটক। গোসলকালে অনেক পর্যটক পানির স্রোতে তলিয়ে যান। বিপদাপন্ন পর্যটকদের উদ্ধার ও সচেতনতায় একযুগেরও বেশি সময় আগে শুরু হয় বেসরকারি সংস্থা সি-সেইফ লাইফগার্ডের সেবা কার্যক্রম। কিন্তু পর্যটকদের প্রাণ রক্ষায় কাজ করা বেসরকারি সংস্থাটির কার্যক্রম থেমে যাচ্ছে তহবিল সংকটে।

প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত সুগন্ধা-কলাতলী-লাবণী সৈকতে ‘লাল-হলুদ জার্সি’ পড়া কিছু যুবক বাঁশি বাজিয়ে ও উদ্ধার সরঞ্জাম নিয়ে একবুক পানিতে চলে যাওয়া পর্যটকদের তীরের কাছাকাছি চলে আসতে হাঁকডাক দেন। সোয়া যুগ ধরে চলে আসা চেনা সেই চিত্র আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ফলে পহেলা অক্টোবর থেকে সৈকতে গোসলে নামা পর্যটকরা থাকবে ঝুঁকিতে। গোসলকালে স্রোতের টানে ভেসে গেলে থাকবে না উদ্ধার তৎপরতা। সঙ্গে কর্মসংস্থান হারাবেন ২৭ জন লাইফগার্ড কর্মীসহ সংস্থার ৩৫ জন।

পর্যটনসেবীদের তথ্যমতে, পুরো বছরে কক্সবাজার সৈকত ভ্রমণে আসেন অর্ধকোটিরও বেশি পর্যটক-দর্শনার্থী। ১২০ কিলোমিটার সৈকতে পর্যটক সমাগম বেশি থাকা লাবনী-সুগন্ধা-কলাতলী পয়েন্টের পাঁচ কিলোমিটার অংশে ২৭ জন লাইফগার্ড কর্মী পালা করে সেবা দিয়ে আসছেন এক যুগের বেশি সময় ধরে। কিন্তু এসময় বাকি আরও ১১৫ কিলোমিটার সৈকত অরক্ষিত অবস্থায় থেকেছে। এখন লাইফগার্ড সেবা বন্ধ হলে এ পাঁচ কিলোমিটারও অরক্ষিত হয়ে পড়বে। লাইফগার্ড সেবা বন্ধ হয়ে গেলে পর্যটকরা নিরাপত্তার হুমকিতে পড়বেন। ভাটা পড়বে সৈকত ভ্রমণে আসা পর্যটন শিল্পে।

তথ্য বলছে, গত ৭ সেপ্টেম্বর বিকেলে সৈকতের লাবণী পয়েন্টে গোসলে নেমে নিখোঁজ হন ক্রিকেটার মুশফিকের খালাতো ভাই শরিফুল ইসলামের ছেলে বগুড়ার কলেজছাত্র আয়মান (১৭)। ১৬ ঘণ্টা পর সমিতিপাড়া সৈকতে তার মরদেহ ভেসে আসে।

আর ৭ জুলাই সকালে মেরিন ড্রাইভের প্যাঁচারদ্বীপের হিমছড়ির সৈকতে গোসলে নেমে ভেসে যান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থী অরিত্র হাসান, সাদমান রহমান ও আসিফ আহমেদ। দুই ঘণ্টা পর হিমছড়ি সৈকতেই সাদমানের আর পরদিন ৮ জুলাই সকালে কক্সবাজার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের নাজিরারটেক শুঁটকিমহাল সৈকতে পাওয়া যায় আসিফ আহমেদের মরদেহ। কিন্তু আড়াই মাস অতিক্রান্ত হলেও অরিত্রের সন্ধান মেলেনি। এসব তথ্য জানার পর লাইফগার্ড সেবা কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার খবরে পর্যটকরা আরও হতাশ।

বিদেশি সংস্থা ‘রয়্যাল ন্যাশনাল লাইফবোট ইনস্টিটিউট’র (আরএনএলআই) অর্থায়নে ২০১২ সাল থেকে সি-সেইফ লাইফগার্ড সৈকতে সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। গত একযুগে ২৭ জন লাইফগার্ড কর্মী সৈকতের কলাতলী থেকে লাবণী পয়েন্ট পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটারে স্রোতের টানে ভেসে যাওয়া অন্তত ৮১৫ পর্যটক-দর্শনার্থীকে উদ্ধার করেছেন। এতে প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন তারা। একই সময় স্রোতের টানে বা রিপ-ক্যানেলে পড়ে সলিলসমাধি হয়েছে ৬৫ জনের।

সি-সেইফ লাইফগার্ডের সিনিয়র কর্মী ও ট্রেইনার মোহাম্মদ ওসমান বলেন, গত সপ্তাহেও সৈকতের সুগন্ধা ও লাবণী পয়েন্টে ভেসে যাওয়ার সময় সাতজনকে উদ্ধার করা হয়। চলতি বছরের এসময় পর্যন্ত সৈকতে গোসলে নেমে ভেসে গিয়ে মারা যান ১১ পর্যটক। এছাড়া ভেসে যাওয়ার কালে উদ্ধার করা হয় আরও ১৭ জনকে।

ঢাকার পর্যটক আহসান শাওন বলেন, বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার সবাইকে বিমুগ্ধ করে। তাই ভ্রমণ বললেই, প্রথম পছন্দ কক্সবাজারের সৈকত ও বেলাভূমি। সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্পের বিকাশে সৈকত, বেলাভূমিসহ সকল পর্যটন অনুষঙ্গে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু গোসলে ভেসে যাওয়াদের উদ্ধারে কাজ করা লাইফগার্ডরা বেসরকারি অর্থায়নে সেবা দিয়ে আসছিল জানা ছিল না।

তিনি বলেন, বিকশিত পর্যটনকে সমৃদ্ধ করতে সৈকতে গোসলকালীন পর্যটক নিরাপত্তায় লাইফগার্ড সেবা সচল রাখার দায়িত্ব জেলা প্রশাসন বা বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির তত্ত্বাবধানে নেওয়া দরকার। নতুবা ধীরে ধীরে নিজস্ব স্বকীয়তা হারাবে কক্সবাজারের পর্যটন।

সি-সেইফ লাইফগার্ড সংস্থার আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, তহবিল সংকটে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে সি-সেইফ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছিল। পর্যটকদের নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসকের তৎপরতায় দাতা সংস্থা প্রকল্পের মেয়াদ গত জুন পর্যন্ত ছয় মাস বাড়ায়। এরপর দ্বিতীয় দফায় ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আরও তিন মাস বাড়ানো হয়। অর্থের যোগান না হওয়ায় চলতি সেপ্টেম্বরেই লাইফগার্ড সেবা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানে ২৭ জন লাইফগার্ড কর্মীসহ ৩৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা হিসেবে মাসে গড়ে ১৪ লাখ টাকা যোগান দিত সংস্থাটি। বছরে লাগত দেড় কোটি টাকার মতো।

গত ২৮ আগস্ট কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উন্নয়ন কাজের অগ্রগতি পরিদর্শনে এসে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন সন্ধ্যায় পর্যটনের স্টেক হোল্ডারদের নিয়ে বৈঠকে বসেন। সেখানে বন্ধের পথে থাকা সৈকতের লাইফগার্ড ইস্যুটি আলোচনা হয়। কিন্তু সরকারি অর্থায়নের যোগানের পরিবর্তে বিষয়টি নিয়ে হোটেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বসে করণীয় নির্ধারণে জেলা প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দিয়ে যান তিনি। কিন্তু এরপর আর কোনো বৈঠক হয়নি। সিদ্ধান্ত না এলেও কার্যক্রম বন্ধের দিনক্ষণ দ্রুতই এগিয়ে আসছে।

লাইফগার্ড হিসেবে সেবা দেওয়া নাইক্ষ্যংছড়ির জয়নাল আবেদীন বলেন, লাইফগার্ডের প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর থেকে গত এক যুগ এটা করেই সংসার চালিয়েছি। সমুদ্রে কোনো পর্যটক ভেসে গেলে আমরা ঝুঁকি নিয়ে জীবন বাঁচাই, এখন আমাদের জীবনটাই ঝুঁকিতে পড়ে গেলো। দীর্ঘ এ সময়ে ১০ মরদেহ উদ্ধারের পাশাপাশি একাই ৯৮ পর্যটকের প্রাণ বাঁচাতে পেরেছি। এখন আমাদের বাঁচানোর কেউ নেই। হঠাৎ অন্য পেশায় থিতু হতেও সময় লাগবে, লাইফগার্ডের প্রশিক্ষণ নিয়ে সেটা কাজে লাগাতে না পারলে খারাপই লাগবে।

আরেক লাইফগার্ড কর্মী বান্দরবানের লামার আকরাম ত্রিপুরা বলেন, গত প্রায় একযুগ লাইফগার্ড হিসেবে সৈকতে সেবা দিচ্ছি। ২০ হাজার টাকা বেতনে স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে শহরের লাইটহাউসে ভাড়া বাসায় থেকে সংসার টানতে হিমশিম খেতাম। চাকরিহীন আগামী মাস থেকে কীভাবে সংসার চালাবো ভেবে পাচ্ছি না।

বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির তত্ত্বাবধায়ক ও এডিএম মো. শাহিদুল আলম বলেন, তহবিল সংকটের কারণে লাইফগার্ড সেবা সেপ্টেম্বরে বন্ধ হওয়ার বিষয়টি পর্যটন মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা হলো, সৈকত এলাকার হোটেলগুলোর মাধ্যমে লাইফগার্ড সেবা চালু রাখতে হবে। এক্ষেত্রে সৈকত এলাকার তারকা হোটেলগুলো তিনজন এবং ছোট হোটেলগুলোকে একজন করে লাইফগার্ডের বেতন পরিশোধ করতে হবে। হোটেল ব্যবস্থাপনার নীতিমালায় লাইফগার্ড পরিচালনার বিষয়টি উল্লেখ আছে। নিয়োগের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বর্তমান লাইফগার্ডদের অগ্রাধিকার দেওয়া যায়।

এডিএম আরও বলেন, এ বিষয়ে হোটেল মালিকদের সঙ্গে জেলা প্রশাসনের কথা চলছে। কিন্তু হোটেলমালিকেরা এ সিদ্ধান্ত এখনো মানেননি।

কক্সবাজার হোটেল ও গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার বলেন, হোটেলসমূহের ব্যবস্থাপনায় লাইফগার্ড পরিচালনার নির্দেশনা পর্যটন মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসন থেকে দেওয়া হলেও হোটেলমালিকরা মাসে ১৪-১৫ লাখ টাকার জোগান দিতে পারবে কি না, সন্দেহ আছে। এ বিষয়ে কেউ সাড়াও দিচ্ছেন না। প্রশাসনের নির্দেশনায় সাড়া দিলেও সেটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে অক্টোবরে বন্ধ হতে যাওয়া লাইফগার্ড সেবা চালু রাখা অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে।

ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার রিজিয়নের প্রধান অতিরিক্ত ডিআইজি আপেল মাহমুদ বলেন, ভেসে যাওয়া পর্যটকদের মুখে বাঁশি, কাঁধে উদ্ধার সরঞ্জাম নিয়ে উদ্ধার করে আনেন লাইফগার্ড কর্মীরা। লাইফগার্ড না থাকলে কত পর্যটকের মৃত্যু হতো, তা সহজে আন্দাজ করা যায়। অক্টোবর থেকে লাইফগার্ড আর থাকছে না, তখন পর্যটকের কী হবে এটা ভাবনায় ফেলেছে সবাইকে।

কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, পর্যটন অনুষঙ্গ হিসেবে লাইফগার্ড অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতদিন বেসরকারি সংস্থা চালিয়েছে, এখন সরকারি বা হোটেল কর্তৃপক্ষের অর্থায়নে চলবে কি না সেটা সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং বাস্তবায়ন করা সময়সাপেক্ষ বিষয়। কিন্তু এ সেবা বন্ধ করা সমীচীন নয়। যতদিন বিকল্প ফান্ড আসবে না, ততদিন বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির তহবিল থেকেই বেতন-ভাতা দিয়ে লাইফগার্ড সেবা সচল রাখা যায়। বিচ কেন্দ্রিক নানা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, হোটেল-মোটেল ও খেলাধুলার অনুকূলে বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির ফান্ডে কোটি টাকা জমা হয় বলে জনশ্রুতি আছে। সেই টাকা পর্যটক নিরাপত্তায় ব্যবহার করাই তো যায়।