খুলনায় ৪৮ ঘণ্টায় ৩ খুন, পুলিশের দাবি ‘টার্গেট কিলিং’

Bangla Post Desk
বাংলা পোস্ট প্রতিবেদক
প্রকাশিত:০৫ আগস্ট ২০২৫, ০৩:২১ পিএম
খুলনায় ৪৮ ঘণ্টায় ৩ খুন, পুলিশের দাবি ‘টার্গেট কিলিং’

খুলনায় গত শুক্রবার রাত থেকে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টায় তিনজন খুন এবং একজন গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। হত্যাকাণ্ড যারা ঘটিয়েছেন তারা চিহ্নিত সন্ত্রাসী বলে দাবি উঠলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন তারা।

এসব হত্যাকাণ্ডকে ‘টার্গেট কিলিং’ বলে অভিহিত করেছে পুলিশ। তবে এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কেউ গ্রেপ্তার না হওয়ায় এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

পুলিশসহ স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, গত শুক্রবার (১ আগস্ট) রাতে নিজ বাড়িতে দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে খুন হন সোনাডাঙ্গা থানাধীন সবুজবাগ এলাকার মনোয়ার হোসেন টগর নামের এক যুবক। দুর্বৃত্তরা ওই রাতে টগরের বাড়ির দরজার কড়া নেড়ে তার সঙ্গে ৫ মিনিট ধরে কথোপকথনের একপর্যায়ে বুকে ছুরিকাঘাত করে তাকে হত্যা করে। 

পরে বাড়ির আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে আসামিদের শনাক্ত করতে পারলেও তাদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। এ ঘটনায় টগরের বাবা জামাল হাওলাদার সাত আসামির নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা আরও চার-পাঁচজনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেন।

পুলিশ ও সবুজবাগ এলাকার স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, টগর স্থানীয় কয়েকজন সন্ত্রাসী ও মাদক কারবারির সঙ্গে চলাফেরা করতেন। পরিবারের পক্ষ থেকে সন্ত্রাসী কার্যকালাপ থেকে দুরে থাকার জন্য তাকে বারবার বলা হলেও সে কর্ণপাত করেননি।

ঘটনার দিন রাতে তিনটি মোটরসাইকেলযোগে সাতজন ব্যক্তি তাদের বাড়িতে প্রবেশ করেন। তারা সবাই টগরের পরিচিত বলে জানা গেছে। 

স্থানীয় সূত্রে আরও জানা যায়, টগরের কাছে ওই সন্ত্রাসীরা টাকা পেত। সেই টাকা পরিশোধের জন্য সন্ত্রাসী একটি গ্রুপ তাকে প্রায়ই চাপ দিত। সেই টাকা পরিশোধ না করায় টগরকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়।

সোনাডাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শফিকুল ইসলাম নিহত টগরের স্ত্রীর বরাত দিয়ে বলেন, টগর আগে খুলনার শীর্ষ সন্ত্রাসী গ্রেনেড বাবুর ‘বি’ কোম্পানির সদস্য ছিলেন। পরে তিনি পলাশ-কালা লাভলুর গ্রুপে যোগ দেন। মাদক কারবারের টাকা নিয়ে সন্ত্রাসীরা তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে।  হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া দুর্বৃত্তরা নিজেদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন বন্ধ রাখায় তাদের অবস্থান শনাক্ত এবং গ্রেপ্তার করা সম্ভব হচ্ছে না।

এদিকে সেদিনই শেষ রাতের দিকে দিঘলিয়া উপজেলার বারাকপুর গ্রামে খুন হন ভ্যানচালক আলামিন সিকদার।

ঘটনা প্রসঙ্গে থানার ওসি এইচ এম শাহীন বলেন, স্ত্রী রিপা বেগমের দ্বিতীয় স্বামী ছিলেন আলামিন সিকদার। প্রথম স্বামী আসাদুলের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার কারণে আলামিন রিপাকে বিয়ে করেন। আর এর জেরে ভোরে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয় আলামিনকে।

নিহতের ভাই ফারুক সিকদার এ ঘটনায় আসাদুলের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় আরও দুই-তিনজনের বিরুদ্ধে থানায় হত্যা মামলা করেন। ওসি জানান, আসাদুলকে গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।

অন্যদিকে, রবিবার (৩ আগস্ট) রাত পৌনে ৮ টার দিকে নগরীর ২ নম্বর কাস্টমঘাট এলাকার একটি সেলুনের সামনে অবস্থান নেওয়া যুবক সোহেলকে লক্ষ্য করে গুলি করে সন্ত্রাসীরা। মোটরসাইকেলযোগে আসা সন্ত্রাসীদের মাথায় হেলমেট এবং মুখ ঢাকা ছিল। সন্ত্রাসীদের ছোড়া একটি গুলি সোহেলের পেটে বিদ্ধ হয়। তিনি বর্তমানে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

এ প্রসঙ্গে খুলনা উপ-পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) মো: আবু তারেক বলেন, ‘এ ঘটনায় থানায় এখন পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। আমরা বিভিন্নস্থান থেকে বিভিন্ন ধরনের তথ্য পাচ্ছি। সেগুলো যাচাই-বাছাই করে আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো হচ্ছে। রাতে শহরের নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন স্থানে টহল বাড়ানো হয়েছে। স্পর্শকাতর স্থানে চেকপোষ্ট বসানো হয়েছে। আমাদের অভিযানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন কেএমপি পুলিশ কমিশনার জুলফিকার আলী হায়দার।’

একই রাতে নগরীর মহেশ্বরপাশা উত্তর বণিকপাড়া এলাকার খানাবাড়ির সামনে গলা কেটে হত্যা করা হয় ঘের ব্যবসায়ী আলামিনকে। ঘটনার ১২ ঘণ্টার বেশি সময় অতিবাহিত হলেও এ ঘটনায়ও পুলিশ এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।

দৌলতপুর থানার ওসি মীর আতাহার আলী বলেন, সোমবার (৪ আগস্ট) সকালে নিহতের ভাই আওলাদ হোসেন বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেছেন। 

তিনি জানান, ঘটনাস্থলে আশপাশের সিসি ক্যামেরাগুলো নষ্ট থাকায় খুনিদের শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। ঘটনার রাতেই আসামিদের গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশ অভিযান চালিয়েছে।

এদিকে গত কয়েকমাস ধরে খুন, রাহাজানিসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব আ্যাডভোকেট বাবুল হাওলাদার।

তিনি বলেন, ‘গত বছর রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হওয়ার পর অনেক চিহ্নিত সন্ত্রাসী জেল থেকে বেরিয়ে গেছে। লুট হওয়া অস্ত্রও উদ্ধার হয়নি। তাদের গ্রেপ্তার এবং অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে। এ ছাড়া রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর পুলিশ প্রশাসনের কাঠামো ভেঙে পড়েছে। বর্তমান অর্ন্তবর্তী সরকার তাদেরকে কাউন্সিলের মাধ্যমে মনোবল ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। পুলিশের কার্যক্রম যেন দায়সারা। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড রুখতে পুলিশকেই দায়িত্ব নিতে হবে।’

সার্বিক বিষয়ে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) সহকারী পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) খন্দকার হোসেন আহম্মদ বলেন, ‘এই হত্যাকাণ্ডগুলো টার্গেট কিলিং। পুলিশের একার পক্ষে এসব নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। বিভিন্ন সময় খুনিদের গ্রেপ্তার করা হয়, কিন্তু আদালতের মাধ্যমে তাদের আবারও জামিন হয়ে যায়।’