রাকসু নির্বাচন নিয়ে তৎপরতা নেই ছাত্রদলে

Bangla Post Desk
বাংলা পোস্ট ডেস্ক
প্রকাশিত:২২ আগস্ট ২০২৫, ১২:১৭ পিএম
রাকসু নির্বাচন নিয়ে তৎপরতা নেই ছাত্রদলে

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে ছাত্রসংগঠনগুলো প্যানেল গোছানোর পাশাপাশি জয় পেতে নানা ‘ছক কষছে’। তবে ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে রাকসু নিয়ে ছাত্রদলের তৎপরতা দৃশ্যমান নয়। সবশেষ রাকসু নির্বাচনে সফলতা পাওয়া ছাত্রসংগঠনটির এমন অবস্থানের পেছনের কারণ নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে চলছে নানা বিশ্লেষণ।

দীর্ঘ ৩৫ বছর পর আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর রাকসু নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, নির্বাচনের মনোনয়নপত্র সংগ্রহের সময় শুরু হওয়ার কথা ছিল গত বুধবার সকাল নয়টা থেকে। তবে আগের দিন মধ্যরাতে এক বিজ্ঞপ্তিতে তা স্থগিত করে নির্বাচন কমিশন। বুধবার বিকেলে এক জরুরি বৈঠকে আগামী রোববার থেকে মনোনয়নপত্র বিতরণ শুরু হবে বলে নতুন সিদ্ধান্ত হয়, যা চলবে মঙ্গলবার বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত।

অন্যান্য ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠন যেখানে ‘সম্মিলিত প্যানেল’ গোছাতে নড়েচড়ে বসেছে, সেখানে ছাত্রদল কোনো প্রস্তুতিই শুরু করেনি। কে হবেন ভিপি (সহসভাপতি), জিএস (সাধারণ সম্পাদক), এজিএস (সহসাধারণ সম্পাদক) পদপ্রার্থী, সেটি নিয়েও কোনো আলোচনা নেই। প্রকাশ্যে কিংবা কৌশলে সংগঠনের নেতা-কর্মীদের প্রচার-প্রচারণা দেখা যায়নি। অবশ্য নানা দাবি নিয়ে ক্যাম্পাসে প্রায়ই কর্মসূচি পালন করছেন ছাত্রদলের নেতা–কর্মীরা। সংগঠনের অভ্যন্তরে রাকসু নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কোনো আলোচনা হয়নি বলে জানিয়েছেন একাধিক দায়িত্বশীল নেতা। বৃহৎ একটি ছাত্রসংগঠনের এমন অবস্থান শেষ পর্যন্ত ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সুষ্ঠু’ নির্বাচন আয়োজন নিয়ে শঙ্কার কথাও আলোচনায় আছে।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন রাকসু নির্বাচনের জন্য যথাযথ পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারেনি বলে অভিযোগ তুলেছেন শাখা ছাত্রদলের সভাপতি সুলতান আহমেদ। গতকাল বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, ‘শিক্ষক-কর্মকর্তাদের কর্মবিরতির জন্য একদিকে যেমন ক্লাস হচ্ছে না, অন্যদিকে আমরাসহ ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলোর কোনো দাবি-প্রস্তাবনাও মেনে নেয়নি প্রশাসন। নির্বাচন কমিশনও মগবাজার থেকে পাওয়া প্রেসক্রিপশন একটা সংগঠনের ওপর বাস্তবায়ন করছে। এমন প্রেক্ষাপটে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন নিয়ে আমরা শঙ্কায় আছি। আমরা অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক রাকসু নির্বাচন চাই। অবিলম্বে আমাদের দাবিদাওয়া পূরণের আশ্বাস দিলেই আমরা প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করব।’

এ বিষয়ে রাকসুর নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মো. আমিনুল হক বলেন, ‘বৃহৎ একটি ছাত্রসংগঠন নির্বাচনে অংশ না নিলে প্রশ্ন উঠতেই পারে। আমরা সবাইকে নিয়েই অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন উপহার দিতে চাই। এ ক্ষেত্রে ক্যাম্পাসের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নির্বাচন সম্পন্ন করাটা বেশ চ্যালেঞ্জিং হবে। ছাত্রদলের যেসব অভিযোগ, সেগুলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সমন্বয় করতে হবে। আমাদের এ ক্ষেত্রে তেমন কিছু করার নেই।’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রায় এক দশক পর ১৯৬২ সালে রাকসু প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর মোট ১৪টি নির্বাচন হয়েছে। সর্বশেষ ১৯৮৯ সালে রাকসু নির্বাচন হয়েছিল। ভিপি (সহসভাপতি) হয়েছিলেন তৎকালীন ছাত্রদল নেতা রুহুল কবির রিজভী।

ছাত্রদল সূত্রে জানা যায়, গত ২৪ বছরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শাখা ছাত্রদলের মাত্র সাতটি কমিটি হয়েছে। এর মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়েছে মাত্র তিনটি। বাকি তিনটি আহ্বায়ক কমিটি ছিল। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বর্তমানে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের একক আধিপত্য ও দৌরাত্ম্যে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা প্রকাশ্যে কর্মসূচি পালন করতে পারেননি। ২০১৮ সালের পর মাঝেমধ্যে লুকিয়ে ঝটিকা মিছিল, ধর্মঘট ও হাতে গোনা কিছু শিক্ষার্থীবান্ধব কর্মসূচি ছাড়া দাঁড়াতে পারেনি সংগঠনটি।

চার বছর আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে কার্যক্রম চলার পর ১৬ আগস্ট শাখা ছাত্রদলের ১১৩ সদস্যবিশিষ্ট আংশিক পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ছাত্রদল। পাশাপাশি ছাত্রদের ১১টি হলে আংশিক কমিটি গঠন করা হয়। তবে কমিটিতে স্থান পাওয়া অধিকাংশ নেতা-কর্মীই হলের বাইরে অবস্থান করেন।

এদিকে নবগঠিত কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ দলের শীর্ষ অন্তত ২০ নেতার নিয়মিত ছাত্রত্ব নেই। বিষয়টি নিয়ে একধরনের ‘ইমেজ সংকটে’ ভুগছে সংগঠনটি। শীর্ষ নেতাদের নিয়মিত ছাত্রত্ব না থাকায় রাকসু নির্বাচনে তাঁরা প্রার্থী হতে পারবেন না। বাকি যাঁদের ছাত্রত্ব আছে, তাঁদের ক্যাম্পাসে পরিচিতি কম। ফলে দলটি নেতৃত্ব সংকটে পড়েছে।

ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে আছেন এমন একজন সক্রিয় নেতা নাম প্রকাশ না করা শর্তে কে বলেন, ‘অন্যান্য ছাত্রসংগঠন যেখানে রাকসু নির্বাচন নিয়ে নানা তৎপরতা চালাচ্ছে, সেখানে আমাদের দলের অভ্যন্তরে কোনো আলাপ-আলোচনা হয়নি। শীর্ষ নেতাদের নিয়মিত ছাত্রত্ব না থাকায় একধরনের নেতৃত্ব সংকট তৈরি হয়েছে। তবে হল পর্যায়ে যাদের নির্বাচন করার ইচ্ছা আছে, তাদের ভালো কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ একই সুরে কথা বলেন দলটির সহসভাপতি পদে আছেন এমন দুজন নেতা।

নেতাদের ‘আগ্রহ কম’

১৬ আগস্ট শাখা ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার আগে ১১ সদস্যের একটি আংশিক কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তাঁরা প্রত্যেকেই পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে আগের দায়িত্বেই বহাল রয়েছেন। এই নেতাদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী সাত নেতার নিয়মিত ছাত্রত্ব নেই। ফলে তাঁরা রাকসু নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। শীর্ষ নেতাদের ছাত্রত্ব না থাকায় ছাত্রদলের রাকসু নির্বাচন নিয়ে ‘অনাগ্রহ’ রয়েছে বলে ক্যাম্পাসে আলোচনা রয়েছে।

নিয়মিত ছাত্রত্ব আছে ও ক্যাম্পাসে পরিচিতি আছে—এমন নেতার সংকট তৈরি হয়েছে দলের মধ্যে। এই অনিয়মিত ছাত্রদের তালিকায় আছেন সভাপতি সুলতান আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক সরদার জহুরুল ইসলাম, জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি শাকিলুর রহমান, সহসভাপতি মেহেদী হাসান, সাবিহা আলম, বুলবুল রহমান, ফারুক হোসেন, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তাহের রহমান, তুষার শেখ, এহেসানুল হক প্রমুখ। অনিয়মিত ছাত্রদের মধ্যে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ অনেকেই অর্ধযুগ আগে পড়াশোনা শেষ করেছেন। এ ছাড়া কমিটিতে শীর্ষ পদে আছেন, এমন অধিকাংশ নেতার নিয়মিত ছাত্রত্ব নেই।

এদিকে ১৬ আগস্ট ছাত্রদের ১১টি হলে ছাত্রদলের আংশিক কমিটি গঠন করা হয়। গঠিত হল শাখা ছাত্রদলের মোট ২২ জন সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে ১১ জনই অনাবাসিক শিক্ষার্থী। হল কমিটিকে সাত দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত হয়নি। যাঁদের হলে নির্বাচন করার আগ্রহ আছে, তাঁদের শিক্ষার্থীবান্ধব কাজ করার জন্য বলা হলেও নেতা-কর্মীদের এমন কোনো কাজ চোখে পড়েনি। এ কারণে সাংগঠনিক দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকছেন সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা।

ছাত্রদলের প্যানেলে আলোচনায় যারা

শীর্ষ নেতারা নির্বাচনে অংশ নিতে না পারায় নিয়মিত ছাত্রত্ব আছে—এমন নেতাদের শীর্ষ পদে বেছে নিতে হবে দলটিকে। তবে কে হবেন ভিপি (সহসভাপতি), জিএস (সাধারণ সম্পাদক), এজিএস (সহসাধারণ সম্পাদক) পদপ্রার্থী, সেটি এখন পর্যন্ত ঠিক হয়নি। দলের নেতাদের মধ্যে নিয়মিত ছাত্রত্ব ও ক্যাম্পাসে পরিচিতি আছে, এমন নেতার সংখ্যা হাতে গোনা কয়েকজন। তবে শেষ পর্যন্ত যদি ছাত্রদল নিজেদের প্যানেল গঠন করে তাহলে যাঁরা শীর্ষ পদপ্রার্থী হতে পারেন, তাঁরা হলেন ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহমুদুল মিঠু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহিন বিশ্বাস এষা, দপ্তর সম্পাদক নাফিউল জীবন, সহসভাপতি শেখ নূর উদ্দীন আবির।

প্যানেল গোছাতে ‘সময় চায়’ ছাত্রদল

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, ছাত্রদলের দায়িত্বশীল তিনজন নেতা ও অন্যান্য ক্রিয়াশীল ছাত্রনেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘদিন পর ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণা হওয়ায় তাঁরা এখনো সবকিছু গুছিয়ে উঠতে পারেনি। এ জন্য বিএনপিপন্থী জ্যেষ্ঠ শিক্ষক ও ছাত্রদল নেতারা মৌখিকভাবে প্যানেল গোছাতে সময় চেয়ে ‘অনুরোধ’ করেছেন। তবে ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি বিবেচনায় সময় বৃদ্ধি করতে নারাজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এতে রাকসু নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আগে বেশ কিছু দাবি জানিয়ে আন্দোলন করে আসছে দলটি।

গণ–অভ্যুত্থানে বিরোধিতাকারী ফ্যাসিস্ট শিক্ষকদের বিচার, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনসহ সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বেশ কিছু প্রস্তাব দিয়েছে ছাত্রদল। তবে ছাত্রদলের অভিযোগ, বৃহৎ একটি ছাত্রসংগঠন হওয়া সত্ত্বেও বর্তমান প্রশাসন তাদের কোনো দাবিদাওয়া পূরণ করেনি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ছাত্রদল অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের জন্য মৌখিকভাবে সময় চেয়ে প্রশাসনের কাছে অনুরোধ করেছে। এ ছাড়া শীর্ষ নেতারা যেন নির্বাচনে অংশ নিতে পারে সে জন্য ডাবল মাস্টার্স কিংবা এমফিলের শিক্ষার্থীদের যেন সুযোগ দেওয়া হয় সেই অনুরোধও জানায় নেতারা। তবে ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে তাদের সময় দেওয়া হয়নি। এ জন্য প্রশাসনের প্রতি ছাত্রদলের ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে।’

বৃহৎ একটি রাজনৈতিক সংগঠনের এমন অবস্থানের কারণে নির্বাচনে শঙ্কা প্রকাশ করে ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মুহাম্মদ আলী রেজা কে বলেন, ‘রাকসু নির্বাচন আমাদের সামনে যেমন সম্ভাবনা তুলে ধরেছে, তেমনি একধরনের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। বড় একটা রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠন নির্বাচনের বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। সবাইকে নিয়ে রাকসু নির্বাচন করতে না পারলে একটা সহিংসতার পরিবেশ তৈরি হয় কি না। বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠন-পাঠন আবার বাধাগ্রস্ত হয় কি না।’