ঘুরে আসুন টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ
বাংলাদেশ পর্যটন শিল্পের সঙ্গে প্রতিধ্বনির মতোই ধ্বনিত হয় কক্সবাজারে অবস্থিত পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের কথা। বঙ্গোপসাগরের ফেনীল জলরাশিকে দৃষ্টি সীমায় রেখে এই সৈকত ধরে টেকনাফ পর্যন্ত রচনা করা যায় এক অতুলনীয় ভ্রমণের উপাখ্যান। বালুকাবেলার শুভ্রতার সঙ্গে সারি বেঁধে দাঁড়ানো ঝাউ গাছের গাড় সবুজ; এরই মাঝে হঠাৎ একঝাঁক দুধ রঙা পাখি যেন প্রকৃতির এক অদ্ভূত খেয়াল। এমন প্রাকৃতিক নৈসর্গকে প্রাণভরে উপভোগের জন্য এখন পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে সদ্য নির্মিত মেরিন ড্রাইভ। অপার সম্ভাবনাময় সড়কটি উপকূল ভ্রমণকে এক অপূর্ব মাত্রা দিয়েছে। চলুন, কক্সবাজার থেকে টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কপথটি দিয়ে সৈকত ভ্রমণের বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
মেরিন ড্রাইভ সড়কের অবস্থান
বিখ্যাত কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের পাশ দিয়ে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটিই মেরিন ড্রাইভ। এর শুরু হয়েছে কক্সবাজারের কলাতলী মোড়ে আর শেষ হয়েছে টেকনাফের শাপলা চত্বরের জিরো পয়েন্টে।
মেরিন ড্রাইভের নির্মাণ ও তাৎপর্য
বাংলাদেশ সড়ক ও জনপথ বিভাগের অধীনে এই দৃষ্টি নন্দন সড়কটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। ২০১৭ সালের ৬ মে সড়কটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। ২০১৮-এর ২৬ জুন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সড়কটিকে সংরক্ষিত পর্যটন অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করে। শুধু পর্যটনই নয়, এই সড়ক নির্মাণের মধ্য দিয়ে দেশের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি,পরিবহন খাতে উন্নতি এবং সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি মঞ্চ স্থাপিত হয়েছে।
ঢাকা থেকে কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভ যাওয়ার উপায়
এই সড়ক পরিদর্শনের জন্য প্রথমে সরাসরি কক্সবাজার চলে আসতে হবে। ঢাকার ফকিরাপুল, কলাবাগান, কল্যাণপুর, গাবতলী ও যাত্রাবাড়ী থেকে কক্সবাজারের নিয়মতি বাস রয়েছে। শ্রেণি ভেদে এগুলোর টিকিট মূল্য জনপ্রতি ৯০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা। বাস যোগে কক্সবাজার আসতে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লাগে।
ট্রেনে আসার ক্ষেত্রে কমলাপুর কিংবা বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন থেকে সরাসরি কক্সবাজারের ট্রেন রয়েছে। সিটের ধরনভেদে যাত্রীপ্রতি ভাড়া পড়ে ৬৯৫ থেকে ২ হাজার ৩৮০ টাকা। আর কক্সবাজার পৌঁছতে সময় নেয় প্রায় ৯ ঘণ্টা।
আরও দ্রুততম সময়ে যাওয়ার জন্য রয়েছে সরাসরি কক্সবাজার ফ্লাইট ব্যবস্থা। প্লেন যাত্রার মাধ্যমে সর্বোচ্চ ১ ঘণ্টার মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছা যায়।
কক্সবাজার পৌঁছার পর মেরিন ড্রাইভে যাওয়ার চাঁদের গাড়ি, ট্যুরিস্ট জিপ, ছাদ খোলা জিপও মাইক্রোবাস পাওয়া যাবে সুগন্ধা পয়েন্ট থেকে। পর্যটন মৌসুমের ওপর ভিত্তি করে এই পরিবহনগুলোর ভাড়া কম-বেশি হয়ে থাকে। বিশেষত অফ সিজনে চান্দের গাড়ি ভাড়া ৬ হাজার টাকা, সেখানে পিক টাইমগুলোতে পড়বে প্রায় ৭ হাজার টাকা। খোলা জিপ বা চান্দের গাড়িগুলোতে ১০ থেকে ১২ জন পর্যন্ত এক সঙ্গে যাওয়া যায়।
পুরো মেরিন ড্রাইভ ঘুরে আসতে সময় লাগে প্রায় ৫ ঘণ্টা। সময় সংকুলান না হলে পুরোটা না ঘুরে হিমছড়ি বা ইনানী বিচ পর্যন্ত যেয়ে ফিরে আসা যেতে পারে।
মেরিন ড্রাইভ ভ্রমণে কী কী দেখবেন
দরিয়ানগর
কলাতলীর ভাঙার মোড় বা মেম্বার ঘাটা পেরিয়ে কিছুদূর গেলেই পড়ে দরিয়ানগর। এখানে রয়েছে দৃষ্টি নন্দন একটি ব্রিজ, যেখান থেকে সমুদ্রের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। অপর পাশে রয়েছে সুউচ্চ পাহাড় এবং পার্ক। একটি সাদার রঙের হাঙ্গরের ভাস্কর্যের প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকতে হয় এই পার্কে।
এই অংশের সৈকতটি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় প্যারাসেলিং-এর জন্য। এতে খরচ পড়ে জনপ্রতি ২ থেকে আড়াই হাজার টাকা।
হিমছড়ি
ছোট বড় শীতল পানির ঝর্ণা, পাহাড় আর ছবি তোলার জন্য দারুণ একটি জায়গা এই হিমছড়ি। তবে ঝর্ণার আসল সৌন্দর্য দেখার একমাত্র উপায় হলো বর্ষাকালে আসা। শীতের মৌসুমে ঝর্ণাগুলোয় পানি থাকে না বললেই চলে। পাহাড়ের নিচে ইকোপার্কের প্রবেশ মুখে রয়েছে একটি বার্মিজ মার্কেট।
ঝিনুক বাজার
মেরিন ড্রাইভে একদম সড়কের ধারেই এই বাজারটি। পর্যটকরা স্যুভেনির হিসেবে এখান থেকে কিনে নিতে পারেন বিভিন্ন রঙের শামুক ও ঝিনুকসহ নানা ধরনের সামুদ্রিক জিনিস।
প্যাচার দ্বীপের কাঁকড়া সৈকত
হিমছড়ি থেকে কিছুদূর গেলেই পড়বে সৈকতের এই পয়েন্টটি। এ অংশের সৈকত পর্যন্ত যাওয়ার জন্য রয়েছে বাঁশ-গাছ দিয়ে বানানো একটি কাঁকড়া ব্রিজ। সৈকতের প্রবেশপথে দুপাশে চোখে পড়বে ঘন ঝাউবন। এখানেও সুযোগ রয়েছে প্যারাসেলিং-এর।
সোনারপাড়া সৈকত
রেজুখাল ব্রিজ পেরিয়ে একটু সামনে গেলেই পাওয়া যাবে এই মনোমুগ্ধকর সৈকতটি। ঝাউগাছে আচ্ছাদিত সৈকত কতটা সুন্দর হতে পারে তা দেখতে হলে অবশ্যই আসতে হবে সোনারপাড়া সৈকতে।
ইনানী সৈকত
মেরিন ড্রাইভের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর এবং জনপ্রিয় হচ্ছে ইনানী বিচ। হিমছড়ির পর আরও ১৫ কিলোমিটার গেলে পাওয়া যাবে এই প্রবাল সৈকতটি।
ভাটার সময় এখানে সেন্টমার্টিনের মতো পানির নিচের প্রবাল পাথরগুলো ঊঁকি দিতে শুরু করে। কক্সবাজারের মতো উত্তাল না হওয়ায় এখানকার শান্ত সাগর আরও বেশি মুগ্ধ করে দর্শনার্থীদের।
অ্যাকোয়াহলিক ট্যুরিস্ট ক্যারাভান
শুধুমাত্র মেরিন ড্রাইভ ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বানানো এই পরিবহনটি মূলত বিশেষভাবে তৈরি একটি ছাদ খোলা ডাবল ডেকার বাস। এটিতে চড়ার মাধ্যমে এক নজরে দেখে নেওয়া যাবে উপরোল্লিখিত সবগুলো স্থান। এছাড়াও এই পরিষেবার নিয়মিত তালিকায় রয়েছে পাটুয়ার টেক, শামলাপুর হিলভিউ বিচ, টেকনাফ বিচ, অ্যাকোয়াজোন-১ ও ২, সাব্রাং এবং টেকনাফের জিরো পয়েন্ট।
এক নজরে সমুদ্র সৈকতসহ অর্ধচন্দ্রাকৃতির সাম্পান, পাহাড়, নারিকেল ও ঝাউবন দেখার জন্য এর থেকে উৎকৃষ্ট উপায় আর হয় না। এমনকি এই ক্যারাভানে কিচেন, লাইব্রেরি, ওয়াইফাই ও ওয়াশরুমেরও ব্যবস্থা রয়েছে। এদের বিভিন্ন প্যাকেজে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সকাল, দুপুর ও সান্ধ্যকালীন খাবার। সাধারণ সময়সীমা সকাল ৯ টা থেকে ৬ টা পর্যন্ত হলেও পিক টাইমগুলোতে বিকাল সাড়ে ৪টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্তও আয়োজন রাখা হয়।
ছাদ খোলা (উপরের) ডেকের ভাড়া ২ হাজার ২৯৯ টাকা এবং নিচের ডেকের টিকিট মূল্য ২ হাজার ৯৯ টাকা। ৩ থেকে ৭ বছর বয়সের শিশুদের জন্য রাখা হয় ১ হাজার ৫৯৯ টাকা।
মেরিন ড্রাইভ ঘুরতে যাওয়ার সেরা সময়
এই সড়ক ঘোরার জন্য সবচেয়ে আরামদায়ক সময় হলো শীতকাল; বিশেষ করে ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাস। ভ্রমণের পরিকল্পনা এমনভাবে করা উচিত যেন বিকালের আগেই ইনানী বিচে পৌঁছানো যায়। কেননা সমুদ্রের বুকে সূর্যাস্ত দেখার জন্য এমন জায়গা সারা দেশে দ্বিতীয়টি নেই।
আবহাওয়া অনুকূল থাকার কারণে ভিড়টা অনেক বেশি থাকে এ সময়। সেই সঙ্গে আবাসিক ও খাবার হোটেলগুলোসহ বিভিন্ন সেবা নেওয়ার জন্য চওড়া দাম দিতে হয়।
অপরদিকে,ঝড়-বাদল বা বৃষ্টির মৌসুমগুলো তথা এপ্রিল থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়গুলোতে পর্যটক অনেক কম থাকে। সঙ্গত কারণে সবকিছুর দামও অনেকটাই কমে আসে।
তবে ভালো আবহাওয়ায় তুলনামূলক সাশ্রয়ী খরচে ঘুরে বেড়াতে নভেম্বরের শেষ ভাগ অথবা মার্চের শুরুর দিকটা বেছে নেওয়া যেতে পারে।
মেরিন ড্রাইভ ভ্রমণে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা
দেশে ও বিদেশে ব্যাপকভাবে সমাদৃত একটি দর্শনীয় জায়গা হওয়াতে অনেক আগে থেকেই এখানে গড়ে উঠেছে প্রায় পাঁচ শতাধিক হোটেল-মোটেল ও কটেজ। অফ সিজনে অগ্রিম বুকিং-এর প্রয়োজন পড়ে না,তবে ডিসেম্বর থেকে জানুয়ায়ি পর্যন্ত অগ্রিম বুকিং দেওয়া আবশ্যক। মূলত সৈকত ও মেইন রোড থেকে যত দূরত্ব বাড়ে, হোটেলের ভাড়াও তুলনামূলকভাবে ততোই কমতে থাকে।
প্রতিটি দর্শনীয় স্থানেই বিভিন্ন মানের রেস্তোরাঁ রয়েছে। মেরিন ড্রাইভ সড়কের ধারে বিভিন্ন পয়েন্টে থাকা রেস্তোরাঁগুলো থেকে উদরপূর্তি করে নেওয়া যায়। বিভিন্ন জায়গায় গাড়ি থামিয়ে ঘুরে বেড়ানো, ছবি তোলা এবং স্থানীয় খাবার খাওয়ার আলাদা আনন্দ রয়েছে। তবে ট্যুরিস্ট ক্যারাভানে গেলে ভ্রমণ ও আহারের জন্য আলাদা করে চিন্তার প্রয়োজন হবে না।
ভ্রমণকালে প্রয়োজনীয় সতর্কতা
• কলাতলী থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চেকপোস্ট পড়বে। এই চেকিংয়ের সময় প্রদর্শনের জন্য জাতীয় এবং পেশাগত পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখা জরুরি।
• অন বা অফ কোনো সিজনেই হোটেল নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্থানীয় পরিবহন চালকদের পরামর্শ নেওয়া উচিত নয়।
• জিপ, মাইক্রো, চান্দের গাড়িতে ওঠার সময় গাড়ি চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখে নেওয়া উচিত। সেই সঙ্গে দীর্ঘ পথে ফাঁকা থাকার পরেও গতির উপর চালকের নিয়ন্ত্রণ আছে কি না, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা অপরিহার্য।
• সড়কপথসহ,পার্ক,পাহাড় বা সৈকতে ঘুরে বেড়ানোর ক্ষেত্রে কোনোভাবেই পরিবেশ নোংরা করা যাবে না।
পরিশিষ্ট
কক্সবাজার থেকে টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়ক সৈকত ভ্রমণের আকর্ষণ এবং আভিজাত্যকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে। বিশেষ করে ঐতিহ্যবাহী চান্দের গাড়ি বা জিপের সেরা বিকল্প হিসেবে ট্যুরিস্ট ক্যারাভান রোমাঞ্চ ও সমুদ্রবিলাসের এক যুগান্তকারী মেলবন্ধন। পথের এক ধারে সবুজ গাছের সারি অন্যদিকে উপকূলরেখা দেখার সময় চোখ জুড়ে যেন কিছুতেই ক্লান্তি নামে না। এই অবকাশ যাপনকে শতভাগ উদযাপনের জন্যই দীর্ঘ পথের বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন রয়েছে চেকপয়েন্ট। এই নিরাপত্তা কার্যক্রমের সঙ্গে সহযোগিতা করার জন্য পর্যটকদের জাতীয় এবং পেশাগত পরিচয়পত্র রাখা জরুরি। সর্বপরি, এই মেরিন ড্রাইভের মাধ্যমে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যাওয়ার মাইলফলক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।