ধ্রুপদী ফুটবলের রাতে গৌরবময় সময়ে ফেরার ইঙ্গিত বার্সেলোনার

Bangla Post Desk
ইউএনবি
প্রকাশিত:১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০৬:৩০ পিএম
ধ্রুপদী ফুটবলের রাতে গৌরবময় সময়ে ফেরার ইঙ্গিত বার্সেলোনার

হাজারো সংকটের মাঝেও কীভাবে লক্ষ্যে অটল থেকে, মাথা ঠান্ডা রেখে জয় ছিনিয়ে আনতে হয়, তা-ই যেন দেখিয়ে চলেছেন হান্সি ফ্লিক। একের পর এক খেলোয়াড়ের চোট এবং ক্লাবের আর্থিক সংকটে নতুন খেলোয়াড় না পেয়ে একাডেমি লা মাসিয়া থেকে যুবাদের মূল দলে এনে জোড়াতালি দিয়ে শিষ্যদের মাঠে নামিয়ে চলেছেন এই জার্মান কোচ। অথচ এমনই তার দলের পারফরম্যান্স যা কোটি বার্সাভক্তকে ভুলিয়ে দেয়— দলটি ঠিক কতটা সংকটের মধ্যে সময় পার করছে। আর তেমনই এক স্মরণীয় ম্যাচ তিনি উপহার দিলেন রবিবার রাতেও।

সবশেষ কয়েক ম্যাচ উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে আসার মাঝে দানি অলমো ও পাউ ভিক্তরের নিবন্ধন নিয়ে জটিলতা, রোনালদ আরাউহোর দল ছাড়ার গুঞ্জন— সব মিলিয়ে ঝটিকাসংকুল সময়ের মাঝে কে ভেবেছিল, এই বার্সেলোনা সম্প্রতি ছন্দে ফিরতে শুরু করা রিয়াল মাদ্রিদকে ৫-২ গোলে বিধ্বস্ত করবে? তাও আবার শেষের অন্তত ৪০ মিনিট দশজন নিয়ে খেলে? অথচ মাঠের খেলায় সেটিই বাস্তবতা হয়ে ধরা দিল। আর হাজারো সমস্যার মাঝে লাল-নীল জার্সির মায়ায় পড়া বিশ্বব্যাপী কোটি কুলেরের হৃদয় বিগলিত করা একটি রাত উপহার দিল দলটি।

পড়তে পড়তে অনেকেরই হয়তো চোখ ভরে উঠবে, কিন্তু মরুর বুকে যে বিজয়গাঁথা বার্সেলোনা রচনা করল, তা কি এসব উপমার তুলনায় কম কিছু?

এদিন ম্যাচের শুরু থেকেই রিয়াল মাদ্রিদকে ছেড়ে কথা না বলার ইঙ্গিত দিলেও মুহূর্তের ব্যবধানে যখন গোল খেয়ে বসল, তখন মনে হচ্ছিল আরও একটি দুঃস্বপ্নময় রাত হতে চলেছে দলটির সমর্থকদের জন্য।

ম্যাচের শুরুতে এমবাপ্পে-ভিনিসিয়ুসের চোখ ধাঁধানো যুগলবন্দী ফুটে উঠলেও চোখের পলকেই তা যেন মিলিয়ে গেল। আর কোথা থেকে উতাল এক হাওয়া এসে বার্সেলোনার খেলোয়াড়দের কানে ফিসফিস করে কী যেন বলে গেল, তাতেই তারা পেয়ে গেল অভাবনীয় বোঝাপড়া আর সমন্বয়ের মূলমন্ত্র।

২২তম মিনিটে লামিনকে দিয়ে যে গোলটি করালেন তার সতীর্থরা, তা তো তারই বহির্প্রকাশ। সতীর্থের কাছ থেকে আসা বল লেভানডোভস্কির ফ্লিকে যেভাবে চুলচেরা পাসের মতো করে অনেকটা দূরে থাকা লামিনের কাছে গেল, তা নেইমার-ইনিয়েস্তার কীর্তির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। আর বল পেয়েই রুদ্রমূর্তি ধারণ করে রুয়েডিগার-ভাসকেসদের বোকা বানিয়ে গোল আদায় করে নিলেন লামিন; একের পর এক ড্রিবলিংয়ের পর দীর্ঘদেহী কোর্তোয়াকে পরাস্ত করে নেইমারের ঢংয়েই উদযাপন করলেন তিনি। সেটি তো আগামী দিনে বার্সেলোনার শুভ সময়ের দিকেই ইঙ্গিত করে!

আবার ৩৬তম মিনিটে পাওয়া পোনাল্টি থেকে যে নিখুঁত শটটি লেভানডোভস্কি নিলেন, অমন সময়ে দলের মোমেন্টাম ফেরাতে তার বিকল্প ছিল কি?

পেনাল্টির কথায় রিয়াল মাদ্রিদের পারফরম্যান্সের বিষয়টি চলে আসে। চরম পেশাদারত্বের সুফল হিসেবে অনেক বাজে সময়েও ম্যাচ জিতে চ্যাম্পিয়ন্স লিগসহ অন্যান্যা শিরোপা জেতার উদাহরণ খুঁজলে ভুরি ভুরি পাওয়া যাবে দলটির। অথচ, গাভিকে কী অপেশাদার এক ফাউল করে রিয়ালকে ম্যাচ থেকে একপ্রকার ছিটকে দিলেন কামাভিঙ্গা! তারপর মাঝমাঠে নিজে যেমন নিজেকে হারিয়ে খুঁজেছেন, তেমনই সতীর্থদের সঙ্গে বোঝাপড়ার অভাবে দলের একের পর এক আক্রমণ অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়েছে। অন্যদিকে, দ্বিতীয় গোল হজম করে থিতু হওয়ার আগেই তৃতীয় গোলটি করে রিয়ালের খেলোয়াড়দের মনোবলের কোমর ভেঙে দিয়েছেন বার্সা অধিনায়ক রাফিনিয়া।

এরপর হাজারো চেষ্টা করেও স্বরূপে ফিরতে পারেননি ভিনিসিউস-এমবাপ্পে-বেলিংহ্যামরা। যে রুয়েডিগার কৌশল ও দক্ষতার ঝলকে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের নিয়ে মাঠে ছেলেখেলা করেন, হতাশায় তিনি চোখে সর্ষের ফুল দেখে একটা সময় থেকে সমানে ফাউল করে গেছেন বার্সার ক্ষুদে ফুটবলারদের। এরপর বালদের করা চতুর্থ গোলটি কার্যত তাদের ম্যাচ থেকেই ছিটকে দিয়েছে।

বিরতির সময় অনেকেই ভেবেছিলেন যে ট্যাকটিকসে পরিবর্তন এনে হয়ত আরও একবার দুর্দান্ত কিছু দেখাবেন আনচেলত্তি, কিন্তু রিয়ালের খেলোয়াড়রা গুছিয়ে ওঠার আগেই রাফিনিয়ার দ্বিতীয় ও বার্সার পঞ্চম গোলটি সব পরিকল্পনা ভেস্তে দিল।

পরে স্টান্সনি লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়লে বার্সেলোনা দশজনের দলে পরিণত হলেও সেই হ্যাংওভার আর কাটিয়ে উঠতে পারেনি লস ব্লাঙ্কোসরা। সেইসঙ্গে ফ্লিক কৌশলে পরিবর্তন আনায় ব্যবধান কমানোর সুযোগটুকুও পায়নি তারা।

গাভিকে উঠিয়ে পেনিয়াকে গোলপোস্ট সামলানোর দায়িত্বে পাঠালে আক্রমণ ও মাঝমাঠের শক্তি কিছুটা যদিও কমত, তবে লামিনকে উঠিয়ে একাধিক পজিশনে খেলার সামর্থ্য রাখা অলমোকে নামিয়ে মাঝমাঠ, আক্রমণভাগ ও গেম ডেভেলপমেন্টে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনেন ফ্লিক। আর দল যখন ৫-২ ব্যবধানে এগিয়ে তখন অলমোকে পেয়ে প্রতিপক্ষকে ত্রিশ মিনিটের জন্য আটকে রাখা পেদ্রি-কাসাদোদের জন্য খুব কঠিন হয়নি। সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সতীর্থদের সাহস জুগিয়েছেন কাপ্তান রাফিনিয়া। তাই লেভানডোভস্কিরা ব্যবধান আর বাড়াতে না পারলেও দশজনের দল নিয়ে ফাইনালের কিং রিয়াল মাদ্রিদকে আধঘণ্টার বেশি সময় ধরে হতাশ করতে থাকাটাও-বা কম কিসের?

সেটিই করে দেখিয়েছেন জার্মান কোচের কৌশল অবলম্বন করে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্লাউগ্রানা জার্সি পরে খেলতে আসা ১০ জনের একটি দল। তাতে বিধ্বস্ত হয়ে সিংহাসন থেকে নেমে যেতে হয়েছে সুপার কাপ চ্যাম্পিয়নদের। পাশাপাশি গত এল ক্লাসিকোতে বার্সেলোনার অপরাজেয় যাত্রার রেকর্ড ছুঁতে চেয়ে ৪-০ গোলে হারের পর দলটির সুপার কাপের রেকর্ডে ভাগ বসাতে চেয়েও হতাশ হয়েছে নিজেদের বিশ্বের সেরা দল হিসেবে দাবি করে আসা, গ্যালাক্টিকোয় ভরা রিয়াল মাদ্রিদ।

অপরদিকে, গত মৌসুমের সুপার কাপের ফাইনালে ৪-১ গোলে হারের পর ৫-২ গোলের জবাব দিয়ে ঐতিহাসিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে অনন্য উচ্চতায় রেখেই রেকর্ড ১৫তম শিরোপা উঁচিয়ে ধরেছে বার্সেলোনা। পাশাপাশি, ফাইনালে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স উপহার দিয়ে লিওনেল মেসির রেখে যাওয়া ব্যাটনটি শক্ত হাতে এগিয়ে নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে শিরোপার ক্যাবিনেট খুলেছেন লামিন ইয়ামাল।