হ্যাটট্রিক করেও হতাশ গিরাসি, হেরেও সেমিফাইনালে বার্সেলোনা

Bangla Post Desk
বাংলা পোস্ট ডেস্ক
প্রকাশিত:১৬ এপ্রিল ২০২৫, ১০:৩১ এএম
হ্যাটট্রিক করেও হতাশ গিরাসি, হেরেও সেমিফাইনালে বার্সেলোনা

হান্সি ফ্লিকের অধীনে বদলে যাওয়া বার্সেলোনার আক্রমণের যে ধার, তার বিন্দুমাত্রও দেখা মিলল না পুরো ম্যাচজুড়ে। ঘর সামলাতেই পার হয়ে গেল নিজেদের খুঁজে ফেরা দলটির সময়। মাঝে তিনটি গোল হজম করে হেরেও গেল, তবুও অগ্রগামিতায় এগিয়ে থাকায় সেমিফাইনাল নিশ্চিত করেছে কাতালান জায়ান্টরা।

জার্মানির জিগনাল ইডুনা স্টেডিয়ামে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের কোয়ার্টার ফাইনালের ফিরতি লেগের ম্যাচটি ৩-১ গোলে জিতেছে বরুসিয়া ডর্টমুন্ড। তবে প্রথম লেগে বার্সেলোনার মাঠে ৪-০ গোলে হেরে থাকায় সেমিফাইনালে ওঠার জন্য পর্যাপ্ত হয়নি দ্বিতীয় লেগের এই জয়। দুই লেগ মিলিয়ে অগ্রগামিতায় ৫-৩ গোলে পিছিয়ে থাকায় শেষ আট থেকেই বিদায় নিতে হয়েছে নিকো কোভাকের শিষ্যদের।

এই ম্যাচে সবচেয়ে বেশি হতাশ হয়েছেন অবশ্য ডর্টমুন্ডের গিনিয়ান স্ট্রাইকার সেরহু গিরাসি। দলের তিনটি গোলের সবগুলো এসেছে তার পা থেকে। হ্যাটট্রিকের রাতে হয়েছেন ম্যাচের সেরা খেলোয়াড়, হয়েছেন এখন পর্যন্ত টুর্মামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতাও; দলকে জেতানোর রাতে তবুও থেমেছে তার যাত্রা।

বার্সেলোনা এদিন নিজেদের পা থেকে কোনো গোলই করতে পারেনি। একটি গোল যে পেয়েছে, তাও ডর্টমুন্ডের কাছ থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া আত্মঘাতী গোল।

তারা যে কতটা নিষ্প্রভ ছিল, পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই তার আভাস পাওয়া যায়। ম্যাচজুড়ে ৫৪ শতাংশ সময় পজেশন ধরে রাখলেও মাত্র দুটি শট লক্ষ্যে রাখতে পারেন লেভানডোভস্কি, রাফিনিয়ারা। অপরদিকে, মোট ১৮টি শটের ১১টি লক্ষ্যে রাখে ডর্টমুন্ড।

এর ফলে টানা ২৪ ম্যাচের অপরাজেয় যাত্রা থামল ফ্লিকের শিষ্যদের। নতুন বছরে এটিই তাদের প্রথম হার। অবসর ভেঙে ফেরা পোলিশ গোলরক্ষক ভয়চিয়েখ স্টান্সনিরও বার্সার জার্সিতে হয়েছে প্রথম হারের অভিজ্ঞতা। নিজের ২৩তম ম্যাচে এসে হারলেন তিনি।

এদিন ধীরলয়ে ম্যাচ শুরু করলেও ঘরের মাঠে নিজেদের জাত চেনাতে খুব বেশি সময় নেয় না ডর্টমুন্ড। পঞ্চম মিনিট থেকে মুহুর্মুহু আক্রমণে বার্সেলোনার রক্ষণ কাঁপিয়ে দিতে থাকে তারা। এর মধ্যে পঞ্চম মিনিটে গোল পাওয়ার দারুণ একটি সুযোগও তৈরি হয় তাদের, কিন্তু গোলমুখ থেকে ফিনিশিংয়ের ব্যর্থতায় গোলবঞ্চিত হয় দলটি। অবশ্য পরে আক্রমণটি অফসাইডে কাটা পড়ে।

আক্রমণের ধারা অব্যাহত রেখে নবম মিনিটে পেনাল্টি আদায় করে নেয় ডর্টমুন্ড। মূলত বক্সের মধ্যে পাসকেল গ্রসকে অহেতুক ফাউল করে স্বাগতিকদের পেনাল্টি উপহার দেন বার্সেলোনা গোলরক্ষক স্টান্সনি। পরে একাদশ মিনিটে পানেনকা কিকে দলকে এগিয়ে নেন গিরাসি।

অগ্রগামিতায় ৪-১-এ ব্যবধান কমিয়ে আরও দুর্দান্ত খেলতে থাকে ডর্টমুন্ড। এর ধারাবাহিকতায় ৩০তম মিনিটে স্টান্সনিকে ফাঁকা পেয়েও তাকে পরাস্ত করতে ব্যর্থ হন মাক্সিমিলিয়ান বায়ার। দুই মিনিট পর দারুণ একটি সুযোগ পান রবের্ট লেভানডোভস্কি। তবে ডর্টমুন্ডের চার ডিফেন্ডারের চাপে শেষ পর্যন্ত তিনিও ব্যর্থ হন।

৩৭তম মিনিটে করিম আদেয়ামির বুলেট শট ফিরিয়ে দেন স্টান্সনি। দুই মিনিট পর লামিন ইয়ামালের ক্রস বক্সে পেয়েও প্রথম ছোঁয়ায় বেশি জোর থাকায় তা আয়ত্তে রাখতে ব্যর্থ হন জুল কুন্দে।

আর এভাবেই ১-০ গোলে এগিয়ে থেকে বিরতিতে যায় ডর্টমুন্ড।

প্রথমার্ধে বলের দখলে কিছুটা এগিয়ে থাকলেও (৫৭ শতাংশ) একেবারেই ছন্নছাড়া ছিল বার্সেলোনা। প্রথমার্ধে কোনো শটই নিতে পারেনি তারা। বিপরীতে ৪৩ শতাংশ সময় বলের দখল রেখেও দুর্দান্ত আক্রমণাত্মক ফুটবল উপহার দেন ডর্টমুন্ডের খেলোয়াড়রা। তাদের ১০টি শটের সাতটিই ছিল লক্ষ্যে।

বিরতির পর মাঠে নেমেও বার্সেলোনার ওপর চাপ অব্যাহত রাখে ডর্টমুন্ড। এর পরিপ্রেক্ষিতে চতুর্থ মিনিটেই দ্বিতীয় গোল করে ব্যবধান কমান গিরাসি।

৪৯তম মিনিটে সতীর্থের কাছ থেকে উড়ে আসা ক্রস মাথার ছোঁয়ায় চকিতে জালে জড়িয়ে দেন এই ডর্টমুন্ডের নাম্বার নাইন।

এর পাঁচ মিনিট পর একটি গোল পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বার্সেলোনা। দুর্দান্ত গতিতে আক্রমণে উঠে ডান পাশে বক্সের বাইরে থেকে গোলমুখে থাকা লেভানডোভস্কির উদ্দেশে জোরালো নিচু ক্রস বাড়ান ফেরমিন লোপেস। বক্সের ভেতর থেকে ডর্টমুন্ড ডিফেন্ডার রামি বেনসেবাইনি তা ক্লিয়ার করতে গিয়ে জালে জড়িয়ে দেন। ফলে অগ্রগামিতায় ৫-২ গোলে এগিয়ে যায় বার্সেলোনা।

এক ঘণ্টা পার হওয়ার আগে আগে গাভিকে উঠিয়ে পেদ্রিকে নামান ফ্লিক। এরপর থেকে বার্সার মাঝমাঠে কিছুটা স্থিতিশীলতা আসে।

তবে ৭৬তম মিনিটে ফের আরেক গোল করে সমর্থকদের উল্লাসে ভাসান গিরাসি। ডান পাশ দিয়ে আক্রমণে উঠে গোলমুখে জোরালো শট নেন ডর্টমুন্ডের ১৮ বছর বয়সী ফরোয়ার্ড জুলিয়েন দুরানভিল, তা ক্লিয়ার করতে গিয়ে খানিকটা সামনে থাকা গিরাসির কাছে বল পাঠিয়ে দেন রোনালদ আরাউহো। সেখান থেকে বল ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়ে নিজের হ্যাটট্রিক পূরণ করেন গিনির এই স্ট্রাইকার।

হ্যাটট্রিক করে অনন্য এক রেকর্ডে নাম লিখিয়েছেন গিরাসি। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে বার্সেলোনার বিপক্ষে প্রথম আফ্রিকান ফুটবলার হিসেবে হ্যাটট্রিক করেছেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, চ্যাম্পিয়ন্স লিগের এক মৌসুমে কাতালান দলটির বিপক্ষে সর্বোচ্চ গোল (৫টি) করা ফুটবলারও এখন তিনি। পাশাপাশি ইউরোপ সেরার এই টুর্নামেন্টের এক আসরে সর্বোচ্চ গোলদাতা (১৩টি) আফ্রিকার খেলোয়াড় হিসেবেও নিজের নাম রেকর্ড বইয়ে তুলেছেন গিরাসি। এই রেকর্ড গড়তে গিয়ে তিনি পেছনে ফেলেছেন ফ্রান্সে জন্ম নেওয়া আইভরি কোস্ট জাতীয় দলের খেলোয়াড় সেবাস্তিয়েন হালের (১১), মিশরের মোহাম্মদ সালাহ (১০) ও সেনেগালের সাদিও মানেকে (১০)।

এ ছাড়াও হ্যাটট্রিকের ফলে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের চলতি মৌসুমে ১৩ গোল করে রাফিনিয়া ও লেভানডোভস্কিকে পেছনে ফেলে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা বনে গেছেন তিনি। সেই সঙ্গে পাঁচটি অ্যাসিস্টে মোট ১৮ গোলে অবদান রেখে ইউরোপের এলিট লিগে স্মরণীয় এক মৌসুম শেষ করে বিদায় নিয়েছেন ২৯ বছর বয়সী এই স্ট্রাইকার।

ব্যবধান ৫-৩ এ নামিয়ে আরও উজ্জীবীত হয়ে ওঠেন নিকো কোভাকের শিষ্যরা। সেইসঙ্গে প্রতাপ দেখাতে থাকে ঘরের মাঠের সমর্থকরাও।

গিরাসির হ্যাটট্রিকের রেশ কাটতে না কাটতেই দুই মিনিট পর ফের গর্জন করে ওঠে জিগনাল ইডুনা। চতুর্থ গোলটি পেয়ে যান ইউলিয়ান ব্রান্ডট। তবে অফসাইডের কারণে বিপদ এড়াতে সক্ষম হয় সফরকারীরা।

এ সময় থেকে ডর্টমুন্ডের আক্রমণে জেরবার হয়ে যায় বার্সেলোনা। বল নিয়ে কারিকুরি কিংবা আক্রমণে ওঠার কথাই ভুলে যায় তারা। কোনোমতে ডর্টমুন্ডের আক্রমণগুলো ঠেকিয়ে নিজেদের ম্যাচে ধরে রাখাই হয়ে ওঠে তাদের মরণপণ।

শেষ পর্যন্ত আর কোনোভাবে গোল না এলে ৩-১ গোলেই শেষ হয় ম্যাচ। এর মাধ্যমে ২৪ ম্যাচ পর ২০২৫ সালে বার্সেলোনাকে প্রথম হারের স্বাদ দিয়েও বিদায় নিতে হয় ডর্টমুন্ডকে। অপরদিকে, হেরেও অগ্রগামিতায় ৫-৩ গোলের ব্যবধানে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করে ফ্লিকের দল।

২০১৮/১৯ মৌসুমের পর এই প্রথম চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনালে উঠল বার্সেলোনা। মাঝে দুবার ইউরোপা লিগও খেলতে হয় কাতালানদের। সেমিফাইনালে বুধবার রাতে ইন্টার মিলান-বায়ার্ন মিউনিখের মধ্যকার বিজয়ী দলের মুখোমুখি হবে তারা।

অপর ম্যাচে ডর্টমুন্ডের মতো কপাল পুড়েছে ইংলিশ ক্লাব অ্যাস্টন ভিলারও। পিএসজির বিপক্ষে ঘরের মাঠে ২-০ গোলে পিছিয়ে পড়েও ৩-২ ব্যবধানে জিতেছেন উনাই এমেরির শিষ্যরা। তবে প্রথম লেগে ৩-১ গোলে হেরে থাকায় অগ্রগামিতায় ৫-৪ ব্যবধানে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করেছে লুইস এনরিকের দল।

এই হারে ২০২৪/২৫ মৌসুমে ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগের একমাত্র দল হিসেবে অপরাজিত থাকার রেকর্ড থেমেছে পিএসজির। বুধবার রাতে রিয়াল মাদ্রিদ-আর্সেনাল ম্যাচে অগ্রগামিতায় বিজয়ী দলের জন্য সেমিফাইনালে মুখোমুখি হওয়ার অপেক্ষায় থাকবে প্যারিসের দলটি।

প্রথম লেগে রিয়ালকে ৩-০ গোলে হারানোয় তিন গোলে এগিয়ে থেকে ফিরতি লেগে সান্তিয়াগো বের্নাবেউতে খেলতে নামবে মিকেল আর্তেতার আর্সেনাল। অন্যদিকে, আরও একটি ঘুরে দাঁড়ানোর আখ্যান লেখার স্বপ্ন নিয়ে মাঠে নামবে কার্লো আনচেলত্তির শিষ্যরা।