১৩৯৯ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবার গেজেটভুক্ত থাকা সত্ত্বেও সরকারি সুবিধার বাইরে রয়েছে

Bangla Post Desk
মাসউদুল হক
প্রকাশিত:২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৬:৪১ পিএম
১৩৯৯ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবার গেজেটভুক্ত থাকা সত্ত্বেও সরকারি সুবিধার বাইরে রয়েছে

সরকারি সকল সুবিধার বাইরে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ গেজেটভুক্ত ১৩৯৯ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পরিবার। গেজেট প্রকাশ হওয়ার ২০ বছর পার হয়ে গেলেও এ সব শহীদের পরিবারের পক্ষ থেকে কেউ আবেদন করেনি। অন‍্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকেও কোনো খোঁজ বা যোগাযোগ করা হয়নি পরিবারের সঙ্গে।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম গত সোমবার ইউএনবিকে দেয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের অধীনে ‘শহীদ, খেতাবপ্রাপ্ত ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা বিতরণ আদেশ, ২০২১’ অনুযায়ী শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে সুবিধা দেওয়া হয়। ২০০৩ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত তিন দফায় গেজেটে ৬ হাজার ৭৫৭ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রকাশ করা হয়। কিন্তু এরমধ্যে ৫ হাজার ৩৫৮ জনের পরিবার আবেদন করে ভাতা নিচ্ছেন। অবশিষ্ট এক হাজার ৩৯৯ জন কোন ভাতা নিচ্ছেন না।

পরিবর্তিত এ পরিস্থিতিতে এ পরিবারগুলোকে চিহ্নিত করার উদ্যোগ নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। ইতোমধ্যে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ঠিকানাসহ তালিকা জেলা প্রশাসকদের কাছে পাঠানো হয়েছে। শহীদ পরিবারগুলোকে চিহ্নিত করা হলে সরকারের উদ্যোগেই তাদের সব-সুযোগ নিশ্চিত করা বলে জানান এই উপদেষ্টা।

উপদেষ্টা বলেন, স্বাধীনতার ৩০ বছরেরও বেশি সময় পর শহীদদের তালিকা হয়েছে। ‘মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের অধীনে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পরিবার ভাতা পেয়ে থাকেন। বেসামরিক শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেট হয়েছে প্রথমে ২০০৩ সালের ৬ অক্টোবর। সামরিক শহীদদের গেজেট হয়েছে ২০০৪ সালের ১২ এপ্রিল। পুলিশ ও বিডিআরের (বর্তমান বিজিবি) শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেট হয়েছে ২০০৫ সালের ১৫ জুন। শহীদদের তালিকায় মোট নাম এসেছে ৬ হাজার ৭৫৭ জনের।’

উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘গেজেটভুক্তদের মধ্যে ৫ হাজার ৩৫৮ জন ভাতা পাচ্ছেন। অবশিষ্ট এক হাজার ৩৯৯ জন কোন ভাতা পাচ্ছেন না। কেন তারা ভাতা পাচ্ছেন না- জানতে চাইলে অফিসাররা বলেন, স্যার এদের পরিবার কখনও আবেদন করেনি।’

‘আমি বললাম রাষ্ট্র কী কোনদিন জানতে চেয়েছে তারা কারা? তারাই রাষ্ট্র এনেছে। যারা রাষ্ট্র এনেছে তারা কৃষক, তারা শ্রমিক, তারা এত চালাক চতুর লোক না, এরা বোকা লোক। তারা এসব বোঝে না, তারা গেজেট বোঝে না। তালিকা বোঝে না।’

তিনি বলেন, ‘যিনি শহীদ হয়েছেন তার স্ত্রী হয়তো গৃহবধূ ছিলেন, সে তো গেজেট বোঝে না। রাষ্ট্র কেন তার কাছে গেল না?’

শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের সদস্যদেরকে মাসিক ৩০ হাজার টাকা হারে সম্মানি ভাতা এবং বছরে ২৩ হাজার টাকা হারে ২টি উৎসব ভাতা, ২ হাজার টাকা নববর্ষ ভাতাসহ আরও কিছু আর্থিক সুবিধা দেওয়া হচ্ছে বলে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে জানা গেছে।

ফারুক ই আজম বলেন, ‘আমি ডিসি সম্মেলনে ডিসিদের নির্দেশ দিয়েছি, কল্যাণ ট্রাস্টও সেখানে (পরিবারের খোঁজে) যাবে। সব ডিসিদের বলা হয়েছে, যারা ভাতা নিচ্ছেন না, এমন শহীদদের তালিকাও তাদের দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেকের ঘরে ঘরে যেতে হবে। গিয়ে আমাকে আগামী ১৫/২০ দিনের মধ্যে জানাতে হবে যে এ শহীদদের অ্যাড্রেস করা হয়েছে। তাদের কেউ আছে, কী নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেট নিয়েছি, তাদের আলাদা করেছি। জেলার ভিত্তিতে আলাদা করেছি এবং জেলা প্রশাসকদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি।’

শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাদের পরিবার রাষ্ট্রের কাছ থেকে কোন সম্মান ও সুবিধা নেয়নি কিংবা পাচ্ছে না জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, ‘এত বছরে কেউ কী এটার খোঁজ কেউ নেয়নি- জিজ্ঞাসা করলে কর্মকর্তারা বলেছেন, না কেউ জিজ্ঞাসাও করেনি। যারা কল্যা  ট্রাস্টে ছিল তাদের কোন দায়বদ্ধতা ছিল না। মন্ত্রণালয়ের তো ছিলই না। আমি কৌতুহল থেকে এ বিষয়টি দেখতে গিয়ে এটি পেয়েছি।’

মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে জানা যায়,  তিন ক্যাটাগরিতে (শহীদ, খেতাবপ্রাপ্ত ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা) ১৮ হাজার ২০০ জন বা তাদের পরিবারকে ভাতা দেয়া হয়। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে এক হাজার ৩৯৯ জনের পরিবার ভাতা নিচ্ছেন না। তারা আবেদন করেননি। ফলে ভাতা পাননি।

অধ্যাদেশ চূড়ান্ত হলে শুরু হবে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা শনাক্তের কাজ:

বিভিন্ন জেলা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে শত শত অভিযোগ এসেছে জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, ‘জামুকা (জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল) আইন সংশোধন করে নতুন অধ্যাদেশ হয়ে গেলে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ পুনর্গঠন করতে পারব। সেখানে আমরা একটা এডহক কমিটি করে দেব। এরপর জামুকা, এডহক কমিটি, প্রশাসন যৌথভাবে যে অভিযোগগুলো এসেছে, সেগুলো যাচাই-বাছাই করবে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা আগে বলেছিলাম যেসব অমুক্তিযোদ্ধা স্বেচ্ছায় মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে চলে যাবেন তাদের ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) দেব, তাদের শাস্তির আওতায় আনব না। সেই সুবাদে ১০/১২ জনের মতো পেয়েছি, যারা স্বেচ্ছায় চলে যেতে আবেদন করেছেন। তারা জাতি ও মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন যে, তারা এটা অন্যায় করেছিলেন। তাদের যাতে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে আমরা তাদের ভাতা বন্ধ করে দিয়েছি।’

‘ইতোমধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠনগুলো থেকে একটি দাবি জানানো হয়েছে, স্বেচ্ছায় চলে যেতে সরকার যাতে সময় নির্ধারণ করে দেয়। তারা বলেছেন, আগামী ২৬ মার্চ পর্যন্ত যাতে সময় বেধে দেওয়া হয়। আমরা তাদের এ দাবি বিবেচনা করছি।’

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা তৈরীকারীদের বিচার হবে :

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা বলেন, ‘যাদের ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত করা হবে, তাদের শাস্তির আওতায় আনা হবে। এটা পুরো জাতির সঙ্গে প্রতারণা। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় যারা ছিল, তদন্তের মাধ্যমে তাদের আইনের আওতায় এনে বিচার করা হবে।’

সাবেক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা:

আওয়ামী লীগ সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে- এ বিষয়ে উপদেষ্টা বলেন, ‘হ্যাঁ, এ ব্যাপারে একটা অভিযোগ জামুকাতেও জমা পড়েছে। আগামী সভাতে আমরা এটা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিচেনায় নেব, আলোচনা করব।’

ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংকে বিপুল অর্থ

মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের বিপুল অর্থ আর্থিকভাবে ঝুঁকিতে থাকা কয়েকটি ব্যাংকে রয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বলেন, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের বড় ফান্ড আছে। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে সব টাকা নিয়ে রেখেছে বেসরকারি ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে। যে ব্যাংকে ১০ কোটি ফেরত দিতে পারে না। সেখানে কল্যাণ ট্রাস্ট ১৬৭ কোটি টাকা জমা রেখেছে। এ টাকা কবে ফেরত পাবে আল্লাহই জানেন।

তিনি বলেন, ‘কেউ না কেউ তো এ ধরনের ব্যাংকে টাকা রেখে সুবিধা নিয়েছেন। এ বিষয়গুলো আমরা দেখছি।’

মুক্তিযোদ্ধা কোটায় প্রায় ৯০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী:

উপদেষ্টা জানান, সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় প্রায় ৯০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে।,‘আমরা সেখানে যাচাই-বাছাই করবো। কারো কোন আপত্তি থাকতে তা আমাদের জানাতে পারবেন। আমরা সেটা দেখবো।’

মুক্তিযোদ্ধাদের মামলা নিষ্পত্তিতে আলাদা বেঞ্চ চাওয়া হবে:

উপদেষ্টা বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন বিষয়ে ২ হাজার ৭০০টির মতো মামলা রয়েছে। ‘এ মামলাগুলো একটা ডেডিকেটেড বেঞ্চে শেষ করার জন্য প্রধান বিচারপতির সাক্ষাৎ চেয়েছি। তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে একটা আলাদা বেঞ্চ চাইব, যাতে সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের মামলা অগ্রধিকার ভিত্তিতে আমরা শেষ করতে পারি।