বঞ্চিত সেজে পদোন্নতি নিয়েছেন দুর্নীতিবাজরাও

Bangla Post Desk
বিশেষ প্রতিবেদন
প্রকাশিত:০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:৫৪ পিএম
বঞ্চিত সেজে পদোন্নতি নিয়েছেন দুর্নীতিবাজরাও

প্রশাসনে ‘বঞ্চিত’ দাবি করে যারা পদোন্নতি নিয়েছেন বা নিচ্ছেন। তাদের মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অসদাচরণের অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে অতীতে বঞ্চিত হওয়া কর্মকর্তাদের দলে ঢুকে তারা পদোন্নতি বাগিয়ে নিচ্ছেন। অথচ এসব কর্মকর্তা আওয়ামী লীগ সরকারের সময়েও সর্বোচ্চ সুবিধাভোগী ছিলেন। তবে তাদের মধ্যে অনেকেই রয়েছেন যারা দুর্নীতি, কিংবা পেশাগত অসদাচরণের জন্য এত দিন পদোন্নতি পাননি।

আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকে সচিবালয়ে চলছে আওয়ামী লীগ আমলে ‘বঞ্চিত’ দাবি করে কর্মকর্তাদের পদোন্নতি। অথচ বঞ্চিত দাবি করলেও অনেক কর্মকর্তা বিরুদ্ধে দুর্নীতিসহ না না অভিযোগ রয়েছে।

সচিবালয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে কর্মরত একাধিক কর্মকর্তারা জানান, আওয়ামী লীগ আমলে বঞ্চিত সেজে অনেকে পদোন্নতি নিচ্ছেন। তারা আওয়ামীপন্থী হিসেবে পরিচিত। এসব কর্মকর্তারা গত ১৬/১৭ বছর গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর ও সংস্থার দায়িত্বে ছিলেন। মাঠ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদ ডিসি পদও তাদের দখলে ছিল। এখন সেসব কর্মকর্তা খোলস পাল্টে বিএনপি-জামায়াত ঘরানার পরিচয় দেওয়া শুরু করেছে।

বিভিন্ন মন্ত্রণালয়-বিভাগের সচিবরাও মৌখিকভাবে তাদের পছন্দের কর্মকর্তাদের জন্য সুপারিশ করছেন। এজন্য দুর্নীতিবাজ ও আওয়ামী সুবিধাভোগীরা এখনো পদোন্নতি ও ভালো পদায়ন পাচ্ছেন।

বঞ্চিতরা আরও বলেন, তারা প্রশাসনের ভেতরে ঘাপটি মেরে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা চালাবেন। অথচ শুধু বিএনপি-জামায়াত সন্দেহে গত ১৬/১৭ বছর ধরে শত শত কর্মকর্তাকে বঞ্চিত রাখা হয়েছিল। তাদের কেউ কেউ এখনো বঞ্চিত।

অন্যদিকে অতীতে বঞ্চিত হওয়া কর্মকর্তাদের দলে ঢুকে তারা পদোন্নতি বাগিয়ে নিচ্ছেন। অথচ এসব কর্মকর্তা আওয়ামী লীগ সরকারের সময়েও সর্বোচ্চ সুবিধাভোগী ছিলেন।

জানা যায়, অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বঞ্চিতদের পদোন্নতি দেয় সরকার। কিন্তু পদোন্নতি প্রাপ্ত উপ-সচিব, যুগ্ম-সচিব ও অতিরিক্ত সচিবদের মধ্যে অনেকের নামে দুর্নীতি ও আওয়ামীলীগ আমলে সুবিধা নেয়ার অভিযোগ রয়েছে।

পদোন্নতি প্রাপ্তদের মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ

দেওয়ান মো. আবদুস সামাদ নামে একজন কর্মকর্তা যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। আর্থিক অনিয়মের কারণে তিনি পদোন্নতিবঞ্চিত ছিলেন। তার পদোন্নতির জন্য ২০২২ সালে তৎকালীন কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য ও নওগাঁ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মুহা. ইমাজউদ্দিন প্রামাণিক জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে আধাসরকারিপত্রও (ডিও) দিয়েছিলেন। এখন রাজনীতির পালাবদলে নিজেদের বদলে নিয়েছেন।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত নোয়াখালীর ডিসি ছিলেন বদরে মুনির ফেরদৌস। তিনিও বঞ্চিতদের কাতারে শামিল হয়ে এবার পদোন্নতি পেয়েছেন। একই সময়ে মানিকগঞ্জের ডিসি ছিলেন ড. রাশিদা ফেরদৌস। তিনিও এবার পদোন্নতি বাগিয়ে অতিরিক্ত সচিব হয়েছেন। এছাড়া পদোন্নতি পেয়েছেন ইমামউদ্দীন কবির, যার বিরুদ্ধে পাবনার এডিএম থাকাকালে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার সময় আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এ সময় স্থানীয় লোকজন জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ঘেরাও করেন। পরিস্থিতি ভয়াবহ হলে ডিসিকেই প্রত্যাহার করা হয়। তাকেও ফেরত আনা হয়। তারা  বিসিএস ১১তম ব্যাচের কর্মকর্তা।

এছাড়া আরও দুজন আওয়ামী লীগের সময়ে ডিসি ছিলেন।তারা হলেন, ঠাকুরগাঁওয়ের সাবেক ডিসি মুকেশ চন্দ্র বিশ্বাস এবং মানিকগঞ্জের সাবেক ডিসি ড. রাশিদা ফেরদৌস। আর্থিক অনিয়ম-দুর্নীতির দায়ে তারা পরে আর পদোন্নতি পাননি। অথচ শেখ হাসিনার পতনের পর এসব কর্মকর্তা খোলস পাল্টে বঞ্চিতের মিছিলে যোগ দিয়ে পদোন্নতি নিয়েছেন।

ক্রেস্ট কেলেঙ্কারির ঘটনায় ওএসডি হয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব বাবুল মিঞা। সরকার বদলের পর সেই তিনিই এক সপ্তাহের মধ্যে তিনটি পদোন্নতি বাগিয়ে নিয়েছেন। বাবুল মিঞা বিসিএস ১৫তম ব্যাচের কর্মকর্তা। একসময় শেখ হাসিনা সরকারের প্রতিমন্ত্রী এ বি তাজুল ইসলামের একান্ত সচিবও (পিএস) ছিলেন। অথচ অন্তর্বর্তী সরকারদায়িত্ব নেওয়ার পর বিএনপি-জামায়াতের ‘বঞ্চিত’ কর্মকর্তার তালিকায় নাম লিখিয়ে পরপর তিনটি পদোন্নতি বাগিয়েছেন। এগুলোর মধ্যে গত ১৩ আগস্ট প্রথম পদোন্নতি পান উপ-সচিব পদে। দুই দিনের মাথায় ১৫ আগস্ট হয়ে যান যুগ্ম সচিব। এর তিন দিনের মাথায় ১৮ আগস্ট আরেকবার পদোন্নতি পেয়ে হন অতিরিক্ত সচিব।

এছাড়াও পদোন্নতি প্রাপ্ত উপ-সচিব, যুগ্ম-সচিব ও অতিরিক্ত সচিবদের মধ্যে আরও অনেকের নামে দুর্নীতি ও আওয়ামীলীগ আমলে সুবিধা নেয়ার অভিযোগ রয়েছে বলে জানা যায়। সম্প্রতি প্রশাসনে পদোন্নতি বঞ্চিত ১৩১ জন যুগ্ম সচিবকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দিয়েছে সরকার। এর আগে দুই দফায় যুগ্ম সচিব পদে ২২৩ জন এবং উপ-সচিব পদে ১১৭ জনকে পদোন্নতি দেয় অন্তর্বর্তী সরকার।

পদসংখ্যা থেকে বেশি সংখ্যক পদে পদোন্নতি

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রশাসনে সিনিয়র সচিব ও সচিবের অনুমোদিত পদ রয়েছে ৬৯টি; কিন্তু কর্মরত আছেন ৭২ জন। অতিরিক্ত সচিবের ১৪২টি পদের বিপরীতে কর্মকর্তা রয়েছেন ৫২৪ জন। অর্থাৎ এ পদে প্রয়োজনের তুলনায় ৩৮২ জন বেশি কর্মকর্তা আছেন। যুগ্ম সচিবের ৩৩২টি পদে রয়েছেন ৮৮৬ জন কর্মকর্তা। এ স্তরেও ৫৫৪ জন অতিরিক্ত কর্মকর্তা রয়েছেন। 

উপ-সচিবের অনুমোদিত পদসংখ্যা ৯৯৮ হলেও এ পদে কর্মরত আছেন ১ হাজার ৫৯১ জন। এর ঠিক বিপরীত চিত্র সহকারী সচিব ও সিনিয়র সহকারী সচিব পদে। সিনিয়র সহকারী সচিব পদে অনুমোদিত পদের সংখ্যা ২ হাজার ৯৭৫টি; কিন্তু কর্মরত আছেন ১ হাজার ২১৭ জন। সহকারী সচিব পদে কর্মরত ১ হাজার ২১৭ জন হলেও পদসংখ্যা ১ হাজার ৩৯৩টি।