ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থিতিশীলতা ফিরতে সময় লাগবে
চলতি বছরের জুলাই মাস থেকে আগস্টের প্রথম দুই সপ্তাহ আন্দোলন-পুনর্গঠনের মধ্যে দিয়েই কেটেছে। এই ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট পতন হয় শেখ হাসিনা সরকারের। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয় গত ৮ আগস্ট। পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে বড় ব্যবসায়ীরা ও বড় বড় গ্রুপ কোম্পানির মালিকরা অনেকেই গা ঢাকা দিয়েছেন, কেউ কেউ বিদেশে চলে গেছেন।
এরইমধ্যে বেশ কয়েকটি জেলায় ভয়াবহ বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এই সব মিলিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে এখনো স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে আসেনি বলে বেশ কয়েকটি গ্রুপ অব কোম্পানির কয়েকজন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। তবে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থিতিশীলতা ফিরে আসতে আরও সময় লাগবে।
এদিকে চলমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নানা ধরনের সমস্যার কথা বলছেন ব্যবসায়ীরা। কোনো কোনো ব্যবসায়ী বলেছেন, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনে দেশে বেশকিছু শিল্প গ্রুপের কারখানা এখন বন্ধ। সেসব কোম্পানির পণ্য সরবরাহ হচ্ছে না। যার প্রভাব বাজারে পড়ছে। কিছু কোম্পানি কাজ চলমান থাকলেও তাদের মধ্যে আতংক কাজ করছে।
দেশে আন্দোলন শুরুর আগেও গ্যাস সংকট ছিল, বাজারে নিত্যপণ্য দাম অস্বাভাবিক ছিল। অন্যদিকে ডলার সংকট ছিল, ছিল চড়া দাম, ব্যাংক পাড়ায় ছিল অস্থিরতা, ছিল বিভিন্ন সংকট, ব্যবসা-বাণিজ্য একটি গোষ্ঠী ভাল করলেও, অপর দিকে বেশিরভাগ ব্যবসায়ী নানা সমস্যায় ছিল। ফলে ব্যবসায় স্বাভাবিক পরিস্থিতি তখনও তেমন একটা ছিল না।
বর্তমানে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ব্যাংকে টাকা উত্তোলনে একটা শর্তের নির্দেশিকা রয়েছ, ফলে নগদ অর্থ উত্তোলন করে যেসব ব্যবসায়ী ব্যবসা কার্যকলাপ চালান, তাদের জন্য একটু সমস্যা হচ্ছে। যদিও এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে অথবা একই ব্যাংকে অন্য একাউন্টে টাকা ট্রান্সফারে লিমিটে কোনো সমস্যা নেই। তারপরও নগদ অর্থ উত্তোলনে নির্দিষ্ট লিমিট ৩ লক্ষ টাকা থাকায় অনেকের সমস্যা হচ্ছে।
অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারনির্ভর পণ্য সরবরাহকারী বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, কারখানার উৎপাদন শুরু হলেও আমদানি হওয়া কাঁচামাল আসা এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। কাঁচামাল সংকট রয়েছে। এছাড়া বিক্রি কমে যাওয়া, ডলারের ঘাটতি, গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট, ব্যাংক খাতে অস্থিতিশীলতা এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে ঋণের অভাবের কারণে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন অনেক ব্যবসা- প্রতিষ্ঠান।
এদিকে যেসব কোম্পানি স্বাভাবিকভাবে ব্যাবসায়িক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের পণ্য সরবরাহকারী অনেক পরিবেশক প্রতিষ্ঠানের মালিক বিগত সরকারের রাজনৈতিক সুবিধাভোগী হওয়ায়, তারা এখনো ব্যবসায় ফিরতে পারেনি। ফলে সারাদেশে পণ্য সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে বেশ কিছু কোম্পানির। বেশকিছু সহযোগী প্রতিষ্ঠান ও তাদের পরিবেশকরা পড়েছেন দুশ্চিন্তায়। তারাও তাদের ব্যাবসায়িক কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চালাতে পারছেন না।
শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে পালানোর পর দেশজুড়ে সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর ও লুট হয়।
দেশের বড় বড় কয়েকজন কোম্পনির মালিক সরকারের কাছ থেকে বেশি সুবিধা নেওয়া এবং সরকারের সঙ্গে যোগসাজশে কাজ করাসহ বিভিন্ন অভিযোগ কয়েকজন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে মামলা করা শুরু হয়েছে।
এছাড়া সরকারের আওয়ামী সরকারের বিশ্বস্ত ও পরিচিত দেশের বড় বড় কোম্পানির কয়েকজন মালিক পালিয়ে থাকা এবং আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান গ্রেপ্তার হওয়ার পর, তার মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নিয়ে নানা সমীকরণ শুরু হয়েছে এবং স্টাফদের মধ্যে একটা আতংক কাজ করছে, কথন কি হয়।
গাজী গ্রুপের মালিক গোলাম দস্তগীর গাজী। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী ও নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। রাজধানীর শান্তিনগর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হন। এরপর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার রূপসীতে গাজী গ্রুপের টায়ার তৈরির কারখানায় লুটপাটের পর আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। গত রোববার রাত ৯টার দিকে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে।
এস আলম গ্রুপ বাজারে থাকায় ঢাকাসহ চট্টগ্রামে অনেক পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে ছিল। তাদের বিরুদ্ধে ব্যাংক দখল কিংবা ঋণ জালিয়াতির অনেক অভিযোগে রয়েছে। তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে একটা আতংক কাজ করছে। বিশেষ করে ভোজ্যতেল ও চিনির ক্ষেত্রে এস আলমের তেল-চিনির দাম আতংক রয়েছে। তাদের ভোজ্যতেল ও চিনির সরবরাহ কতটুকু থাকবে তা নিয়ে বাজারে অস্থিরতা রয়েছে। অন্যদিকে এস আলমের ব্যাংক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তার নিজস্ব কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে একটা আতংক কাজ করছে, ফলে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে আসেনি।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকটি বড় কোম্পানির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বললে, নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা ইউএনবিকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর, আমাদের মালিক যারা সরকারের সঙ্গে বেশি সম্পর্ক ছিল বলে পরিচিত, তাদের বিভিন্ন ভাবে সমস্যা হচ্ছে। এই পরিস্থিতি যে কোন কোম্পানি থাকবে আর কোনটা থাকবে না এ শঙ্কায় ভুগছি। বড় কোনো লেনদেনের হচ্ছে না। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে যতটুকু নয় সেটুকু আমরা করছি।
তিনি আরও বলেন, পরিবেশকরা টাকা দিচ্ছে না খারাপ পরিস্থিতি দেখে। যদিও কোম্পানি আবারও নতুন উদ্যমে চালু করার কথা ভাবছি আমরা। তবে ব্যবসায় খুব নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
বাংলাদেশ পাইকারি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি বশীর আহমেদ বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ব্যবসা বাণিজ্যে একটা প্রভাব পড়েছে। কারণ বেশ কিছু বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক সামনে নেই, কেউ বিদেশ চলে গেছে, কেউবা পালিয়ে বেড়াচ্ছে, বিগত আওয়ামীলীগের সাথে রাজনীতিতে যারা সংশ্লিষ্ট ছিল, চাদরেরই মূলত এই সমস্যাটা হচ্ছে।
বর্তমান ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অবস্থা বিষয়ে তিনি আরও বলেন, ব্যাংকের একটি অ্যাকাউন্ট থেকে সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা তোলা যাচ্ছে। এ কারণে লেনদেন একদম কমে গেছে। পাইকারি কারবার এখনো ২০ শতাংশও হচ্ছে না। এর মধ্যে বন্যা পরিস্থিতি আরও বিপদে ফেলেছে। তাই এখনো ব্যবসা-বাণিজ্যে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে আসেনি।আমি মনে করি ব্যবসা বাণিজ্য স্থিতিশীলতা ফিরে আসতে সময় লাগবে।
এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহা. সেলিম উদ্দিন বলেন, ব্যবসা বাণিজ্য স্থিতিশীলতা ফিরে আনতে সরকার কাজ করছে। কোথাও কোন প্রতিবন্ধকতা থাকলে সে বিষয়ে গুলো সিরিয়াসলি দেখছি। ব্যবসা বাণিজ্য স্থিতিশীলতা রাখার জন্য যা যা দরকার আমরা করবো।
সচিব আরও বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারে এবং স্বাভাবিক গতি যাতে চলমান থাকে, এ বিষয়ে আমাদের সংশ্লিষ্ট সংস্থা/ ডিপার্টমেন্ট কে বলা হয়েছে। আমরা এই মুহূর্তে দেখছি, বাজার যেন স্থিতিশীল থাকে। সাধারণ ক্রেতে যেন হয়রানী না হয়, নিত্য পণ্য যেন স্বাভাবিক থাকে, বাজারে চড়া দাম না হয়। সব মিলিয়ে আমরা কাজ করছি যাতে দেশে ব্যবসা বাণিজ্য কোন প্রতিবন্ধকতা না থাকে।