সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা ব্যর্থ, ভারতবিরোধী অবস্থানে বিএনপি
বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের মতে, শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ভারতের সঙ্গে তাদের দলের সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা দৃশ্যত ব্যর্থ হওয়ায় তারা আরও শক্ত ও প্রকাশ্যে ভারতবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছেন।
জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে, বিশেষ করে ভারতীয় রাজনীতিবিদ ও গণমাধ্যমের ব্যাপক বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচার এবং উসকানিমূলক বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের দলকে এই অবস্থান নিতে হয়েছে বলে দাবি করছেন তারা।
বিএনপি নেতারা বলেন, গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা পালিয়ে সেখানে আশ্রয় নেওয়ায় বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং জনগণ বিশ্বাস করে ভারত ধর্ম কার্ড ব্যবহারসহ বিভিন্নভাবে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, ‘এমন অবস্থায় প্রধান ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল হিসেবে ভারত কী করছে এবং সেখানে কী ঘটছে সে সম্পর্কে বিএনপি চুপ করে থাকতে পারে না। আমরা যদি চুপ করে থাকি তাহলে মানুষ আমাদের ভুল বুঝবে এবং ইসলামী দল এর সুযোগ নেবে বলে আমরা জনপ্রিয়তা হারাতে পারি। তাই আমরা ভারতের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছি।’
তিনি বলেন, আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনে হামলা, জাতীয় পতাকার অবমাননা, ভারতীয় নেতাদের বাংলাদেশবিরোধী বিবৃতি এবং ভারতীয় গণমাধ্যমে চলমান অপপ্রচার ও ভুল তথ্য জনগণ এবং বিএনপির মধ্যে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।
বিএনপির এই নীতি নির্ধারক বলেন,‘এর ফলে বিএনপির অভ্যন্তরে ভারতবিরোধী অবস্থান শক্তিশালী হয়েছে, যার ফলে দলের হাইকমান্ড ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘোষণার জন্য দলের তিনটি সহযোগী সংগঠনকে নির্দেশনা দিয়েছে।’
বাংলাদেশ সম্পর্কে ভুল তথ্য বন্ধের দাবি জানিয়ে এবং ভারতে বাংলাদেশি মিশনগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবিতে রবিবার (৮ ডিসেম্বর) জাতীয়তাবাদী যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদল ভারতীয় হাইকমিশন অভিমুখে পদযাত্রা করে এবং সেখানে স্মারকলিপি দেয়।
ভারতীয় আগ্রাসনের প্রতিবাদে বুধবার(১১ ডিসেম্বর) ঢাকা থেকে আগরতলা অভিমুখে লংমার্চও করবেন তারা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভারত সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ নিলেও তারা এখন পর্যন্ত ভারতের কাছ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া পায়নি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা ২২ সেপ্টেম্বর মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ তাদের দলের নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাত করেছেন এবং এই সময় তারা ইতিবাচকতা আনতে এবং রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলো এবং বিএনপির মধ্যে সম্পর্ক জোরদারের রূপরেখা তুলে ধরেন।
বিএনপি নেতা বলেন, 'আমরা বাংলাদেশের জনগণ ও প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে একটি বার্তা পাঠানোর চেষ্টা করেছি। এতে তাদেরকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে একচেটিয়া সম্পর্ক থেকে সরে আসার আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু আমরা অবাক হয়েছি, ভারত তার অবস্থান থেকে এক ইঞ্চিও নড়েনি।’
তিনি আরও বলেন, তারা এখনো ভারত সরকার, রাজনৈতিক দল ও জনগণের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চান।
বিএনপির এই নেতা বলেন, 'আমাদের বর্তমান অবস্থানের মাধ্যমে আমরা মূলত ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চাইছি। যাতে তারা বাংলাদেশবিরোধী অবস্থান এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে একচেটিয়া সম্পর্ক পুনর্বিবেচনার জন্য ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। যদি তারা তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে তবে আমরা প্রতিদান দেব, কারণ আমরা বিশ্বাস করি যে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
তিনি বলেন, তাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন এবং অতীতের ভুল বোঝাবুঝি নিরসনে আগ্রহী হওয়ায় তিনি সতর্কতার সঙ্গে ভারতবিরোধী মন্তব্য এড়িয়ে চলেছেন। ‘তবে এখন এটা নির্ভর করছে ভারতের ওপর। যদি তারা এগিয়ে না আসে তবে চীনসহ অন্যান্য আঞ্চলিক অংশীদারদের দিকে মনোনিবেশ করে আমাদের কৌশল নির্ধারণ করতে হবে।’
তিনি বলেন, চীন শেখ হাসিনা সরকারকে সমর্থন করলেও ইতোমধ্যেই তারা তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেছে এবং বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক উষ্ণ করতে আগ্রহ প্রকাশ করছে।
বিএনপির এই নেতা বলেন, মধ্যপন্থী গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বিএনপি ভারতবিরোধী বা ভারতপন্থী দল হতে চায় না। ‘বিএনপি কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী থাকবে এবং ভারতের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধেও সোচ্চার থাকবে।’
লন্ডনে স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, একটি রাজনৈতিক দল বিদ্যমান পরিস্থিতি ও বাস্তবতা এবং দেশের স্বার্থের ভিত্তিতে কৌশল নির্ধারণ করে।
তিনি বলেন, বিএনপি এখন ভারতের বিরুদ্ধে সোচ্চার। কারণ প্রতিবেশী দেশটির কিছু রাজনৈতিক নেতা এবং তাদের মিডিয়া বাংলাদেশ ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অস্থিতিশীল করার জন্য দেশের বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে।
বিএনপি সরকার করলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি প্রশ্নে তিনি বলেন, 'ভারতের সঙ্গে আমাদের নীতি নির্ভর করবে আমাদের চাহিদা ও স্বার্থের ওপর। কিন্তু আমাদের সার্বভৌমত্বের ওপর কোনো আঘাত আমরা সহ্য করব না। আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ আমরা মেনে নেব না।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ভারতের উচিত বাংলাদেশের মানুষের পালস বোঝার চেষ্টা করা এবং সে অনুযায়ী নিজেদের অবস্থান ঠিক করা।
তিনি বলেন, ভারত এরই মধ্যে নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ ও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু করেছে। ‘এখন তারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক হারালে তারা কীভাবে একা এগিয়ে যাবে, তা ভারতকে ভাবতে হবে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেছেন, ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে। ‘তারা এখনো শেখ হাসিনাকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। ভারতীয় রাজনীতিবিদদের বক্তব্য ও গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এক ধরনের ঘৃণা ছড়াচ্ছে। ভারতের এই আধিপত্যবাদী মনোভাবের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ।’