জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশে দুই সুপারিশ
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতির সুপারিশ করেছে অন্তর্বর্তী সরকারকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এতে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের ক্ষমতাবলে ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ-২০২৫’ এর দুটি খসড়া রয়েছে, যা জারির সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রথমটিতে বলা হয়েছে, আগামী সংসদের সংবিধান সংস্কার পরিষদ ২৭০ দিনের মধ্যে সংস্কার সম্পন্ন না করলে অন্তর্বর্তী সরকারের তৈরি করে রেখে যাওয়া সংবিধান সংশোধনের খসড়া বিল
পাস হলে গণ্য হবে। দ্বিতীয়টিতে বলা হয়েছে, পরিষদ ২৭০ দিনে জাতীয় সনদ অনুযায়ী সংবিধান সংস্কার করবে।
মঙ্গলবার যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে দেওয়া সুপারিশ এবং আদেশের দুই খসড়ায় আগামী সংসদের সংবিধান পরিষদকে সংস্কারের বাধ্যবাধকতা ছাড়া বাকি অংশ হুবহু এক। কমিশন জানিয়েছে, কোন সুপারিশ গ্রহণ করা হবে, কতটুকু গ্রহণ করা হবে, তা সরকার ঠিক করবে।
গত ১৭ অক্টোবর রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাক্ষরিত জুলাই সনদে নোট অব ডিসেন্ট অন্তর্ভুক্ত করা হলেও বাস্তবায়ন পদ্ধতির সুপারিশে তা নেই। আদেশের খসড়ায় পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠনসহ সংবিধান-সংক্রান্ত ৪৮টি সংস্কার প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, আদেশের ওপর হবে গণভোট। আদেশ জারি থেকে নির্বাচন পর্যন্ত যে কোনো সময়ে গণভোট হবে। আদেশ কে জারি করবে এবং গণভোট কখন হবে– এ সিদ্ধান্ত সরকারকে নিতে সুপারিশ করেছে কমিশন।
সুপারিশে বলা হয়েছে, গণভোটে একটি প্রশ্নই থাকবে। জনগণ ‘হ্যাঁ’ ‘না’ ভোটে মতামত জানাবেন। গণভোটের জন্য অধ্যাদেশ জারি করবে সরকার। আদেশই হবে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি।
গণভোটে আদেশ অনুমোদিত হলে আগামী নির্বাচনে দ্বৈত ভূমিকাসম্পন্ন সংসদ গঠিত হবে। সংসদ সরকার গঠন, আইন ও বাজেট প্রণয়ন করবে। সংসদ সদস্যদের নিয়ে গঠিত হবে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তনে কন্সটিটুয়েন্ট ক্ষমতাসম্পন্ন সংবিধান সংস্কার পরিষদ। পরিষদ জুলাই সনদ অনুযায়ী সংবিধানের সংস্কার করবে।
কমিশনের সুপারিশের সমালোচনা করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘ঐকমত্য কমিশন জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার বদলে অনৈক্য প্রতিষ্ঠার একটা চেষ্টা গ্রহণ করেছে।’
জামায়াতও একে স্বাগত জানায়নি। দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেছেন, গণভোট নির্বাচনের আগেই হতে হবে।
এনসিপি আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া না জানালেও দলটির নেতারা সাংবিধানিক আদেশ জারি করে গণভোট এবং সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের সুপারিশকে ইতিবাচক বলেছেন।
নোট অব ডিসেন্ট নয়, আছে উচ্চকক্ষে পিআর
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মতবিরোধ পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন নিয়ে। পিআরের ঘোর বিরোধী বিএনপি নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) দিয়েছে। বিএনপির মিত্র ১২ দলীয় জোট, এনডিএম এবং জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটও নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে।
জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দল পুরো নির্বাচনে পিআর চায়। এনসিপিসহ কয়েকটি দল অন্তত উচ্চকক্ষে পিআর চায়। চার মাসের সংলাপে পিআর পদ্ধতির উচ্চকক্ষের বিষয়টি সুরাহা করতে না পারা কমিশন আগামী সংসদ থেকেই উচ্চকক্ষ গঠনের সুপারিশ করেছে। এতে ১৪(২) দফায় বলা হয়েছে, সংবিধান সংস্কার সম্পন্নের ৪৫ দিনের মধ্যে নিম্নকক্ষের নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাত পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন করা হবে।
পিআর পদ্ধতির উচ্চকক্ষসহ ৯ মৌলিক সংস্কারে বিএনপির নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে। দলটি বলেছে, নির্বাচনে জয়ী হলে এসব সংস্কার বাস্তবায়ন না করার এখতিয়ার রাখবে। জামায়াত, এনসিপিসহ কয়েকটি দল নোট অব ডিসেন্টের বিরোধী। তারা বলছে, তাদের যেসব প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে, সেগুলোসহ সনদে থাকা ৮৪ সংস্কার কার্যকর করতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টাকে সুপারিশ জমা দেওয়ার পর রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, কিছু কিছু দলের নোট অব ডিসেন্ট থাকলেও সনদ গণভোটে অনুমোদিত হলে সেভাবেই কার্যকর হবে।
জুলাই সনদ স্বাক্ষরের আগের দিন বিএনপির দাবিতে যুক্ত করা হয়– যে দল যে সংস্কার প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে, নির্বাচনে জয়ী হলে সেভাবে সংস্কার করতে পারবে। তবে কমিশনের সুপারিশ এবং আদেশের খসড়ায় এ সুযোগ রাখা হয়নি। বরং বলা হয়েছে, গণভোটে ভিন্নমতের সুরাহা হবে। জনগণ গণভোটে সম্মতি দিলে সে অনুযায়ী সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে।
সংবিধান সংস্কার পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠরা ‘নোট অব ডিসেন্ট’ অনুযায়ী সংস্কার করতে পারবে কিনা– এ প্রশ্নে আলী রীয়াজ বলেন, গণভোটের প্রস্তাব এসেছে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনার সময়। প্রস্তাব ছিল সব কিছুই জনগণের কাছে নিয়ে যাওয়ার। কমিশন মনে করে, কোনো রাজনৈতিক দল জনগণের রায় পাওয়া বিষয়কে কেবল নিজস্ব দলীয় অবস্থান থেকে বিবেচনা করবে না।
সংস্কার বাধ্যতামূলক, না নির্দেশনামূলক?
সুপারিশ অনুযায়ী, আদেশ গণভোটে অনুমোদিত হলে নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে সংসদ এবং সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন হবে। সংস্কার শেষে পরিষদ বিলুপ্ত হবে। সংস্কারে স্পিকার পরিষদপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।
কমিশন আগামী সংসদের সংবিধান সংস্কার পরিষদের জন্য সংস্কার করা বাধ্যতামূলক এবং নিদের্শনামূলক– এ দুই বিকল্প রেখেছে। আদেশের প্রথম খসড়ায় সংস্কার বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ করে বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার তৈরি জুলাই সনদ অনুযায়ী সংবিধান সংশোধন আইনের খসড়া তৈরি করে রাখবে। পরিষদ ২৭০ দিনের মধ্যে সংস্কার না করলে আইনের খসড়া পাস বলে গণ্য হবে। নির্দেশনামূলক পদ্ধতিতে বলা হয়েছে, ‘পরিষদ ২৭০ দিনে জাতীয় সনদ অনুযায়ী সংবিধান সংস্কার করবে’। দুই পদ্ধতিতেই সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সংবিধান সংস্কার করতে পারবে পরিষদ।
উভয় খসড়ায় বলা হয়েছে, আদেশ জারির পর থেকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে যথোপযুক্ত সময়ে অথবা নির্বাচনের দিন গণভোট হবে। দুই খসড়ায় গণভোটের প্রশ্নের ভাষা ভিন্ন। প্রথম খসড়া অনুযায়ী গণভোটের প্রশ্ন হবে– ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং এর তপশিল-১ এ সন্নিবেশিত সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত খসড়া বিলের প্রস্তাবসমূহের প্রতি সম্মতি দিচ্ছেন?’
দ্বিতীয় খসড়া অনুযায়ী গণভোটের প্রশ্ন হবে– ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং এর তপশিল-১ এ সন্নিবেশিত সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবে সম্মতি দিচ্ছেন?’
প্রথম খসড়ার ৩(ট) দফায় বলা হয়েছে, ‘সংবিধান সংস্কার খসড়া বিল’ মানে জুলাই সনদে অন্তর্ভুক্ত সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবের ভিত্তিতে সরকারের তৈরি করা সংবিধান সংস্কারের খসড়া বিল। এই দফাটি দ্বিতীয় সুপারিশের খসড়ায় নেই।
সুপারিশে বলা হয়েছে, সংসদ এবং পরিষদের কার্যপ্রণালি একই হবে। আদেশের দ্বিতীয় খসড়ায় ৮(৩) দফায় বলা হয়েছে, পরিষদের অধিবেশন আহ্বান ও মুলতবি, সংবিধান সংস্কারবিষয়ক প্রস্তাব উত্থাপনের পদ্ধতি, প্রস্তাব বিবেচনা ও গ্রহণ এবং অন্য সব বিষয় কার্যপ্রণালি নির্ধারণ করবে। প্রথম খসড়ায় বলা হয়েছে, সংবিধান সংস্কার বিল উত্থাপন কার্যপ্রণালি নির্ধারণ করবে।
যথেচ্ছ নয়, সনদ অনুযায়ী সংবিধান সংস্কার
অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানান, সনদ অনুযায়ী সংবিধান সংস্কার পরিষদকে সংবিধানে পরিবর্তন আনতে হবে। সে ক্ষেত্রে চাইলেও আগামী জাতীয় সংসদ তাদের ইচ্ছামতো সংবিধানে পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিমার্জন, সংযোজন, বিয়োজন করতে পারবে না।
দীর্ঘ আলোচনার পর রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদে সই করলেও এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে মতভেদ রয়েছে। বিএনপি সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের বিরোধী হলেও জামায়াত এবং এনসিপি এর পক্ষে।
‘কন্সটিটুয়েন্ট পাওয়ার’সম্পন্ন পরিষদ নিজেদের মতো সংস্কার করতে পারবে না বলে স্পষ্ট করেন অধ্যাপক আলী রীয়াজ। কেন পারবে না– এ প্রশ্নে তিনি বলেন, কন্সটিটুয়েন্ট পাওয়ার দেওয়া হচ্ছে এই বিবেচনা থেকে যে, মৌলিক সংস্কার করা হবে। তবে তাদের গাইড করবে জুলাই জাতীয় সনদ। কন্সটিটুয়েন্ট পাওয়ার মানে এই নয়– যা খুশি তাই লিখতে পারা যাবে।
আলী রীয়াজ বলেন, আদেশের অধীন একটি গণভোটের আয়োজন হবে। দ্বিতীয় বিকল্পেও বলা হচ্ছে যে, সরকার আদেশ জারি করবে। সেই আদেশের অধীন গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। গণভোটে একটিমাত্র প্রশ্ন থাকবে। তবে ওই আদেশের তপশিলে যে ৪৮টি সংস্কার প্রস্তাব রয়েছে, সেগুলো অন্তর্বর্তী সরকার বিল আকারে প্রস্তুত করে জনগণের সামনে উপস্থাপন করতে পারে।
দুটি প্রস্তাবের মধ্যে কমিশন কোনটিকে প্রাধান্য দিচ্ছে– প্রশ্নে আলী রীয়াজ বলেন, পার্থক্য রয়েছে শুধু গণভোটের তপশিলে। সরকার চাইলে এগুলো আইনি সাংবিধানিক ভাষায় পরিবর্তন করে বিলের আকারে দিতে পারে অথবা জুলাই জাতীয় সনদে যে ভাষায় লেখা আছে, সেভাবে দিতে পারে।
গণভোটে যদি আদেশ পাস না হয়, তবে কী হবে– প্রশ্নে আলী রীয়াজ বলেন, তার মানে হলো, জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে।
এনসিপি এখনও সনদে সই করেনি। এ প্রসঙ্গে আলী রীয়াজ বলেন, তিনি আশা করছেন, ৩১ অক্টোবর কমিশনের মেয়াদের মধ্যে সব দল এতে সই করবে।
সংবাদ সম্মেলনে ছিলেন কমিশনের সদস্য বিচারপতি এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. মো. আইয়ুব মিয়া, সফর রাজ হোসেন, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
