একনেকে ১৩ প্রকল্প অনুমোদন


জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ১৩টি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এসব প্রকল্পে খরচ ধরা হয়েছে এক হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা।
তবে হাওর ও খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলে জলবায়ু সহনশীল জীবনমান গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে প্রস্তাবিত ‘জলবায়ু সহনশীল জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্প (সিআরএলইপি)’ একনেক সভায় অনুমোদন পায়নি।
জানা গেছে, একনেক সভায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রকল্পটির কাঠামো নিয়ে আপত্তি জানান। তিনি বলেন, জলবায়ু সহনশীলতার নামে এই প্রকল্পে মূল গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ইট-পাথর ও অবকাঠামো নির্মাণে। কিন্তু টেকসই জীবিকা উন্নয়ন ও দারিদ্র্য হ্রাসের বিষয়টি প্রায় উপেক্ষিত। তার এই আপত্তির পর সভায় সিদ্ধান্ত হয়, হাওর অঞ্চলের প্রকৃত চাহিদা অনুযায়ী অবকাঠামো নির্মাণের অংশ কমিয়ে প্রকল্পটি পুনর্গঠন করে পুনরায় একনেকে উপস্থাপন করতে হবে।
এর আগে গণমাধ্যমে এ বিষয়ে এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ‘জলবায়ু সহনশীলতার আড়ালে ইট-পাথরের প্রকল্প’ শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রকল্পের নামে জলবায়ু সহনশীলতার কথা থাকলেও বাস্তবে এটি আরেকটি ‘ইট-পাথরের’ উন্নয়ন উদ্যোগ। হাওর এলাকায় অতিরিক্ত রাস্তা বা ভবন নির্মাণ দীর্ঘদিন ধরেই পরিবেশবিদদের উদ্বেগের কারণ। বন্যা মৌসুমে পানি নামা ও ওঠার স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হয়। ফলে কৃষিজমি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং মাছের প্রজননও ব্যাহত হয়।
মঙ্গলবার (২১ অক্টোবর) প্রধান উপদেষ্টা ও একনেক চেয়ারপারসন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে এনইসি সম্মেলন কক্ষে সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় অনুমোদিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে সরকারি অর্থায়ন এক হাজার ৮৮৫ কোটি ৭ লাখ টাকা, প্রকল্প ঋণ ৫৩ কোটি ২ লাখ টাকা এবং সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন ৫০ কোটি টাকা। এসব প্রকল্পের মধ্যে নতুন তিনটি, সংশোধিত সাতটি এবং ব্যয় বাড়ানো ছাড়া মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে এমন প্রকল্প তিনটি।
সভায় উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, স্বরাষ্ট্র ও কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, বিদ্যুৎ ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বীর প্রতীক এবং পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন।
জানা গেছে, জলবায়ু সহনশীল জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল এক হাজার ২৬৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারের দেওয়ার কথা ছিল ৩০৫ কোটি টাকা, আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিলের ঋণ হিসেবে ৮৫৪ কোটি টাকা এবং ডেনমার্কের উন্নয়ন সংস্থা ডানিডা অনুদান হিসেবে ১০৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা দেওয়ার কথা ছিল। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্বে ছিল স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি)। পাঁচ বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের আওতায় ৩৩৪ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ, ৫৮টি বাজার পুনর্বাসন, ৩৪টি ঘাট নির্মাণ, ৭২টি আশ্রয়কেন্দ্র, ৪৮০টি শৌচাগার ও ৭২০টি নলকূপ স্থাপনের পরিকল্পনা ছিল। এছাড়া ৪০ হাজার যুবককে প্রশিক্ষণ ও ২০ হাজার যুবককে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
তবে পরিকল্পনা কমিশনের মূল্যায়নে দেখা যায়, প্রকল্পের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ অর্থ ব্যয় হবে সড়ক, ঘাট, বাজার ও আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণে। অর্থাৎ, প্রকল্পের নামের সঙ্গে বাস্তব কার্যক্রমের সাযুজ্য নেই। কমিশনের কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লি প্রতিষ্ঠান বিভাগ আগে থেকেই জীবিকা ও প্রশিক্ষণ উপাদান বাড়ানোর পরামর্শ দিলেও তা চূড়ান্ত প্রস্তাবে প্রতিফলিত হয়নি। ফলে পরিবেশ উপদেষ্টার মতামতের ভিত্তিতে একনেক সভায় প্রকল্পটি ফেরত পাঠানো হয়।
অনুমোদিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে কৃষি, পল্লি অবকাঠামো, সড়ক, রেল, স্বাস্থ্য, শিল্প ও বিদ্যুৎ খাতের উদ্যোগ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রকল্প হলো- কক্সবাজারে কৃষি খাদ্য ব্যবস্থা রূপান্তরের মাধ্যমে স্থিতিশীলতা বৃদ্ধির উদ্যোগ, গ্রামীণ কাঁচা রাস্তা টেকসইকরণ প্রকল্প, খুলনা বিভাগের পল্লি অবকাঠামো উন্নয়ন, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের অভ্যন্তরীণ সড়ক ও ফুটপাত উন্নয়ন, উত্তরা লেক উন্নয়ন প্রকল্প, ক্যানবেরায় বাংলাদেশ দূতাবাস ভবন নির্মাণ, কিশোরগঞ্জ থেকে পাকুন্দিয়া-মির্জাপুর টোক সড়ক উন্নয়ন, বিএসটিআইয়ের পরীক্ষাগার সম্প্রসারণ, ঘোড়াশাল তৃতীয় ইউনিট পুনঃশক্তিকরণ, পাবনার মানসিক হাসপাতালকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ইনস্টিটিউটে রূপান্তর এবং রেলওয়ের পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের লেভেল ক্রসিং গেটসমূহের পুনর্বাসন।
একনেক সূত্র জানায়, জলবায়ু সহনশীল প্রকল্পটি ফেরত পাঠানো হলেও এটি বাতিল করা হয়নি। অবকাঠামো নির্ভর কাঠামো পরিবর্তন করে স্থানীয় মানুষের জীবিকা ও প্রশিক্ষণ অংশ জোরদার করার পর প্রকল্পটি পুনরায় একনেকে উপস্থাপন করা যাবে। পরিবেশ উপদেষ্টার মতে, টেকসই উন্নয়নের পথে যেতে হলে প্রকৃতি ধ্বংস নয়, প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবিকা গড়ে তুলতে হবে।
এআর