সাগরপথে ইউরোপে যাওয়ার শীর্ষে এখন বাংলাদেশ

Bangla Post Desk
বাংলা পোস্ট প্রতিবেদক
প্রকাশিত:২৯ জুলাই ২০২৫, ০৫:৫৯ পিএম
সাগরপথে ইউরোপে যাওয়ার শীর্ষে এখন বাংলাদেশ

ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিপ্রবেশের চেষ্টা করছে যে দেশগুলোর মানুষ, বাংলাদেশ এখন সেই তালিকায় পৃথিবীর মধ্যে প্রথম। এ বছরের প্রথম ছয় মাসে অন্তত নয় হাজার ৭৩৫ জ বাংলাদেশি এভাবে ইতালি প্রবেশ করেছেন। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে এভাবে ইতালি প্রবেশ করতে গিয়ে লিবিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে বন্দি রেখে অনেক বাংলদেশি শারিরীক নির্যাতনের শিকার হন। তাদেরকে জিম্মি করে পরিবারের কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে অর্থ। ঘটছে প্রাণহানিও। তবে এতোকিছুর পরেও ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইউরোপের স্বপ্নে লিবিয়া যাওয়ার এই প্রবণতা থামছে না। গত একযুগে এভাবে সাগ পাড়িয়ে দিয়ে ইউরোপে গেছেন অন্তত ৭০ হাজার মানুষ। 

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম বলছে, এভাবে যারা ইউরোপে যাচ্ছে তাদের বেশিরভাগের বয়স ২৫ থেকে ৪০। মাদারীপুর, শরীয়তপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জসহ বাংলাদেশের অন্তত ১০-১২ টি জেলার লোকজন এভাবে ইউরোপে যাওয়ার জন্য মরিয়া।  এসব ক্ষেত্রে এখন সামাজিক যোগাযোগের নানা মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুকের নানা গ্রুপ ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রতারিতরা বা নির্যাতনের শিকার লোকজন দেশে ফিরে মামলা করলেও মূল আসামিরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে। 

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মানব পাচার মামলা সংক্রান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালেই মানবপাচার আইনে এক হাজার ৩৪ টি নতুন মামলা হয়েছে। আর পুরোনো মামলা ধরলে প্রায় সাড়ে চার হাজার মামলা ঝুলে আছে। এর মধ্যে অন্তত তিন হাজার মামলা বিচারাধীন এবং এক হাজারেরও বেশি মামলার এখনো তদন্ত শেষ হয়নি। 

এমন পরিস্থিতিতেই কাল ৩০ জুলাই পালিত হবে আন্তর্জাতিক মানব পাচার বিরোধী দিবস। ২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে ৩০ জুলাই দিনটিকে মানব পাচার দিবস ঘোষণা করে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় “সংঘবদ্ধ অপরাধ মানবপাচার, বন্ধ হোক শোষনের অনাচার”

ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান জানান, “গত কয়েক বছর ধরে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার শীর্ষে বাংলাদেশিরা। এভাবে ইতালি যাওয়ার পথে অনেক প্রানহানি ঘটে। এ ছাড়াও লিবিয়ায় অনেক মানুষ ভয়াবহ নিপীড়নের শিকার। ক্যাম্পে বন্দি রেখে তাদের নিযাতন করা হয়। এরপর পরিবারকে টাকা দিতে বাধ্য করা হয়। এই যে বিদেশে কাজ বা শ্রম অভিবাসনের নামে মানবপাচার এটি ভয়াবহ সমস্যা। পাচারকারীরা এখন তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। সেই তুলনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পিছিয়ে আবার পাচারের মামলাগুলোরও বিচার হচ্ছে না। সবমিলিয়ে পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। 

ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার শীর্ষে বাংলাদেশিরা, ভয়াবহ নির্যাতন লিবিয়ায়:  বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে পাঠানোরে প্রলোভন দেখিয়ে যাদের লিবিয়া নেওয়া হয় তাদের সবাইকে ভালো চাকুরির প্রলোভন দেখালেও তারা চাকুরি পায় না। উল্টো অধিকাংশকেই লিবিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে বন্দি রেখে শারিরীক নির্যাতন করা হয়েছে। তাদেরকে জিম্মি করে পরিবারের কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে অর্থ। তবে এতোকিছুর পরেও ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইউরোপের স্বপ্নে লিবিয়া যাওয়ার এই প্রবণতা থামছে না। 

ইউরোপের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা ফ্রন্টেক্সের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশিরা লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে সবচেয়ে বেশি ইউরোপে প্রবেশে চেষ্টা করে। এটি সেন্ট্রাল মেডিটেরিয়ান রুট হিসেবে পরিচিত। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পযর্ন্ত এই পথে অন্তত ৯২ হাজার ৪২৭ জন বাংলাদেশি ইউরোপে প্রবেশ করেছেন। এভাবে প্রবেশ করতে গিয়ে মাঝে মধ্যেই প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ, এ বছরের জানুয়ারিতে লিবিয়ায় অন্তত ২৩ বাংলাদেশির গলিত লাশ উদ্ধার করা হয় যারা লিবিয়া থেকে নৌযানে করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পরে ভূমধ্যসাগরে সেটি ডুবে যায়।

ব্র্যাকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, এভাবে যারা ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করে তাদের বেশিরভাগ মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, নোয়াখালী, ব্র্যাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা এলাকার। তাদের ৬০ শতাংশের পরিবারকে স্থানীয় দালালরা ভালো চাকুরির প্রলোভন দেখিয়েছিল। কিন্তু ৮৯ শতাংশই চাকুরি বা কোন কাজ পাননি। উল্টো নানা ধরনের ঝুঁকিতে পড়েছেন।  

যাত্রাপথ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ঢাকা থেকে দুবাই-মিসর হয়ে লিবিয়া গেছেন সবচেয়ে বেশি মানুষ। এছাড়া ঢাকা থেকে ইস্তানবুল-দুবাই হয়ে লিবিয়া, ঢাকা থেকে কাতার হয়ে লিবিয়া, ঢাকা থেকে দুবাই-সিরিয়া হয়ে লিবিয়া এবং অল্প কিছু লোক ঢাকা থেকে সরাসরি লিবিয়া গিয়েছেন। 

এভাবে লিবিয়া যাওয়ার পথে ৬৩ শতাংশই বন্দি হয়েছেন। বন্দিদের মধ্যে ৯৩ শতাংশই ক্যাম্পে বন্দি ছিলেন। বন্দিদের ৭৯ শতাংশই শারিরীক নির্যাতনের শিকার। এ ছাড়া লিবিয়ায় পৌঁছানোর পর ৬৮ শতাংশই মুক্তভাবে চলাচলের স্বাধীনতা হারিয়েছেন। ৫৪ শতাংশই বলেছেন, তারা কখনো তিনবেলা খাবার পাননি। অন্তত ২২ শতাংশ দিনে মাত্র একবেলা খাবার পেয়েছেন। 

মানবপাচারের মামলা হলেও বিচার মিলছে না: মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমনে ২০১২ সালে সরকার আইন করার পর থেকে মানবপাচার আইনে নিয়মিত মামলা হলেও অধিকাংশ মামলার বিচার শেষ হচ্ছে না। আবার যেগুলোর বিচার শেষ হচ্ছে সেখানে আসামিরা খালাস পেয়ে যাচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মানবপাচার মামলা সংক্রান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি পযর্ন্ত ৪ হাজার ৩৬০ টা মামলা ঝুলে আছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৪৬ টা মামলা এখনো তদন্তধীন। আর তিন হাজার ১৪ টি মামলা বিচারাধীন। 

মানবপাচারের নতুন রুট ও নতুন কৌশল বাড়ছে: গত এক বছরে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগামের কাছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার ও নির্যাতনের শিকার, আটকেপড়া, জেলে বা ডিপোটেশন ক্যাম্পে বন্দী ৩২৭ জন ভূক্তভোগীর পরিবার সহায়তা চেয়েছেন। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রনালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়, ওয়েজ আনার্স কল্যাণ বোর্ড এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সহায়তায়  বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ৮১ বাংলাদেশিকে নিরাপদে ফিরিয়ে এনেছে। পাচারের শিকার ব্যক্তিদের উদ্ধার ও নিরাপদ প্রত্যাবসনে কাজ করতে গিয়ে দেখা গেছে, মানব পাচারকারীরা এখন শুধু সাগরপথে নয় ভিজিট ভিসা, কনফারেন্স ইনভাইটেশন, ওয়ার্ক পারমিট, এমনকি হজ ভিসাও ব্যবহার করছে। দুবাই- লিবয়িা হয়ে ইউরোপ আবার দুবাই-সার্বিয়া-স্লোভেনিয়া হয়ে ইতালি কিংবা সৌদি আরব  হয়ে নতুন করে যুক্ত হয়েছে রাশিয়া।

দুবাইতে বিউটি পার্লার বা রেস্টুরেন্টে কাজের প্রলভোন দেখিয়ে সেখানে নিয়ে জোরপূর্বক ইচ্ছার বিরুদ্ধে ডান্সক্লাব ও যৌণ ব্যবসায় বাংলাদেশিদের বাধ্য করা হচ্ছে। সেখান থেকে ফেরত আসা চারজন নারীকে উদ্ধারের পর বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে মানবপাচারকারীরা রুট ও দেশ পরিবর্তণ করে বর্তমানে নারীদের ভিজিট ভিসার মালয়েশিয়ায় “বিউটি পার্লারে কাজ” করানোর নামে পাঠাচ্ছে। কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর পর তাদের বিক্রি করে দেওয়া হয়, ডান্স ক্লাবে, এরপর বাধ্য করা হয় যৌন কাজে। এর মধ্যে ছয় নারীকে মালয়েশিয়ার আইজেএমের সহায়তায় গতবছর উদ্ধার করে দেশে ফেরত আনা হয়েছে। 

উদ্ধার এক তরুণী জানান, "আমি তো ভাবছিলাম পার্লারে কাজ করবো। আমাকে বলা হয়েছিল দিনে ৮ ঘণ্টা কাজ, ভালো বেতন। কিন্তু এখানে নিয়ে আমাকে আটকে রাখা হয়। আমি কাঁদতাম, বলতাম আমি পারবো না। কেউ শুনত না।"

এ ছাড়া বাংলাদেশিরা সাইবার স্ক্যামে ভয়াবহ নির্মমতার শিকার হচ্ছেন। মিয়ানমারের ভয়ংকর “স্ক্যাম সেন্টার” থেকে এ বছর উদ্ধার হয়ে আসা ১৮ জন বাংলাদেশি। তারা  জানিয়েছেন, তারা দুবাইতে কাজ করতেন। সেখানে ডিজিটাল প্রতারণার ফাঁদে ফেলে থাইল্যান্ড হয়ে মায়ানমারে নিয়ে যাওয়া হয় এবং অস্ত্রের মুখে দিনের পর দিন কাজ করতে বাধ্য করা হয়। এক ভুক্তভোগী জানালেন: " থ্যাইল্যান্ড থেকে আমাদের চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পরে বুঝতে পারি কোথায় আছি। পালানোর চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু ধরা পড়লে মারধর করত।"

এ ছাড়া ইউরোপে পাঠানোর কথা বলে এখন বাংলাদেশিদের নেপালে নিয়ে আটকে রাখা হচ্ছে। যেহেতু নেপাল প্রবেশে অন অ্যরাইভাল ভিসা আছে সেক্ষেত্রে সহজে পাচারকারীরা কর্মীদেরকে নেপালে নিয়ে যাছে। গতবছরের নভেম্বর মাসে সেদেশে ছয় মাস আটকে রাখা তিন বাংলাদেশি হবিগঞ্জের তুহিনুর ইসলাম অনিক, রহিম খন্দকার ও শাকিব আহাম্মেদকে নেপালের এ্যান্টি প্রাফিকিং ব্যুরোর সহায়তায় উদ্ধার করে দেশে ফেরত এনেছে ব্র্যাক। এ ছাড়াও মানবপাচারকারীরা বর্তমানে আলজেরিয়া, মৌরিতানিয়া, তিউনেশিয়া, রাশিয়া, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, সার্বিয়ার মত দেশ ব্যবহার করছে। 

মাবপাচারের শিকার রোহিঙ্গারাও: বাংলাদেশ থেকে সাগরপথে রোহিঙ্গাদের পাচারও থেমে নেই। ২০১২ থেকে ২০১৫ এই চার বছরে বাংলাদেশ থেকে সোয়া লাখ মানুষ পাচারের শিকার হয়েছে যার বেশির ভাগই রোহিঙ্গা। সেসময় মালয়েশিয়ার সীমান্তবর্তী থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় জঙ্গলে একাধিক গণকবরের সন্ধান মেলে। এরপর মাঝখানে দুই বছর মানবপাচার কমে যায়। এরপর ২০১৭ সালে ২৫ আগস্ট থেকে ১০ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয় বাংলাদেশে। এরপর ফের মানবপাচার চলছে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে ব্র্যাক জেনেছে, বিয়ে আর চাকরির কথা বলে এখন রোহিঙ্গাদের সমুদ্র উপকূল দিয়ে মালয়েশিয়া পাঠানো হচ্ছে। শুধু সমুদ্রপথে নয় কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন জেলাতেও পাচারের শিকার হচ্ছেন রোহিঙ্গারা।