গুম কমিশনের প্রতিবেদনে রোমহর্ষক নির্যাতনের বর্ণনা


‘আমার পা বেঁধে ওপর দিকে রেখে মাথা নিচের দিকে দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। তখন শরীরে কোনো পোশাকই রাখা হয়নি। তারপর খুব সম্ভব বেতের লাঠি দিয়ে এলোপাথাড়ি দুইজনে একসঙ্গে আমাকে পেটাতে থাকে। পরে আমাকে অসংখ্যবার মারতে মারতে এমন হয়েছে যে দেখা গেছে বেঁধে রাখা চোখের কাপড় খুলে গেছে। নাকে-মুখে অনেক চড়-থাপড় দেয় তারা। সেই সময় চামড়া ফেটে রক্ত ঝরে গেছে।
পরে যখন একটা সংকীর্ণ একটা জায়গায় রাখা হয় তখন আমি পেছনে হাত দিয়ে দেখি যে রক্ত পড়ছে। আর এই পেটানোর দাগ প্রায় দেড় বছর পর্যন্ত ছিল। আমি যখন শুয়ে আছি তখন সেখানে থাকা সাইফুল নামের এক ব্যক্তি বলেন যে আপনি উপুড় হয়ে শুয়ে আছেন কেন? আমি বলছি, আমি বসে থাকতে পারছি না। আমাকে ২৫ দিন গায়ে হাত দিয়ে টর্চার করেছে।
২০১৭ সালে র্যাব ২৩ বছর বয়সী এক যুবককে অপহরণ করে ৭২ দিন গুম করে রাখে। ওই ব্যক্তির বর্ণনায় ওপরের নির্যাতনের চিত্র ফুটে উঠেছে। শুধু ওই ব্যক্তি একা নন, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের আমলে এভাবেই অসংখ্য মানুষকে গুম করে লোমহর্ষক নির্যাতন চালানো হতো।
গুম সংক্রান্ত কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের প্রতিবেদনে এমন চিত্র ফুটে উঠেছে। প্রতিবেদনটি গত ৪ জুন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেয় কমিশন। ৫ জুন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে প্রতিবেদনের কিছু অংশ শেয়ার করা হয়।
২০২৩ সালে সিটিটিসি কর্মকর্তারা ৪৭ বছর বয়সী এক ব্যক্তিকে অপহরণ করে ১৬ দিন গুম করে রাখে।
নির্যাতনের শিকার ওই ব্যক্তির বর্ণনায় বলা হয়, চোখে কখনো গামছা দিয়ে কখনো জম টুপি এগুলা দিয়ে বাধা থাকতো। হাত কখনো সামনে, কখনো পেছনে। আর যখন বেশি মারবে তখন এই হাত দিয়ে রাখত আর আমার এই কনুইগুলো, দুই হাঁটু এগুলোতে জোরে জোরে মারতো মোটা লাঠি দিয়ে।
তো আমি মনে করতাম যে আমার হাড় গুলো বুঝি ভেঙে যাবে। কিন্তু পরে দেখলাম যে ফুলে অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু হাড় ভাঙছে এ রকম বুঝিনি। এক পর্যায়ে আমাকে বলা হলো যে তোর হাড় থেকে মাংস আলাদা করে ফেলবো।
তো একজন এ এস আই লোক হবে, তিনি আমাকে দুই হাতে রশি লাগিয়ে ফ্যানের হুকের মধ্যে রশি লাগিয়ে ঝুলিয়ে রাখলো। শুধু পায়ের বুড়ো আঙ্গুলটা লাগানো থাকে মেঝেতে আর পুরো শরীরটা ঝোলানো। হাত এখনো ওঠাতে পারি না, আমার এই দুইটা জোড়ার মধ্যে সমস্যা হয়ে গেছে।
নির্যাতনের শিকার আরেকজনের বর্ণনায়- হাত সম্ভবত গামছা বা কাপড় দিয়ে বেধেছে। আমার এই হাঁটুর ভেতর দিয়ে হাত ঢুকিয়ে এই দুই হাটোর মাঝখান দিয়ে লাঠি ঢুকিয়ে একটা উঁচু কোনো স্ট্যান্ডের মধ্যে রাখছে। আল্লাহর একটা কুদরত কি যখন বাড়ি যেত তখন অনেক কষ্ট লাগতো কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আবারই বাড়ি, অর্থাৎ ব্যথাটা দূর হইয়া যায় সঙ্গে সঙ্গে ব্যথা দূর হয়ে যেত। মাগরিবের পরই মনে হয় কারেন্টের শক দিয়েছিল আমার এই জায়গাটাতে। ওই যে মাগরিবের নামাজ যখন পড়তে পাঠিয়েছে ওই সময় দেখলাম যে আমার হাঁটু কালো হয়ে গেছে। এমন মারা মারছে হাঁটুর ভেতর। তো এরপরে এই হাঁটুর কালো দাগ কষ্ট পেতে ছিল এরপরও নামাজ পড়ছি।
গুম কমিশনের প্রতিবেদনে রোমহর্ষক নির্যাতনের বর্ণনা
আরেক ব্যক্তির বর্ণনায় তার অফিস রুমের ভেতরে ঢোকার পর বাম সাইডে জানালা ছিল। হাত জানালার সঙ্গে বেধে তারা আমাকে পেটায়। তারপর তারা আমাকে বলে যে তুই সন্ত্রাসী-জঙ্গি। তখন তারা আমাকে মেঝেতে ফেলে টর্চার করে। পায়ের যে গিরা আছে কিংবা পায়ের পাতা আছে এগুলোতে তারা টর্চার করে। একবার না কয়েকবারই তারা করছে।
নির্যাতিত আরেকজনের বর্ণনায়, আরেকদিন প্রচুর মারছে। বলছে তোর বাড়িতে আমাদের ইনকোয়ারি গেছে। তোর নামে রিপোর্ট পেয়েছি তোর পরিবার জামায়াত-বিএনপির সঙ্গে জড়িত। তোর নানির বাড়ি করে জামায়াত, আর তোর বাপ করে বিএনপি।
এগুলো বলে বলে আমাকে মেরেছে। মারার এক পর্যায়ে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। পরে মাথায় পানি দিয়ে জ্ঞান ফেরায়।
এই হাত আমার অবস। আমি দাঁড়াইতে পারি না। মানে সোজা দাঁড়াইতে পারি না। এমন অবস্থা যে দাঁড়াইলে আর বসতে পারি না। বসলে আর দাঁড়াইতে পারি না।
এরপর শুরু হলো কারেন্টের শক দেওয়া। আমি যাতে বসতে না পারি সেজন্য আমাকে গ্রিলের মধ্যে হ্যান্ডকাফ দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখতো। পা ফুলে গেছে আমার। হাতে দাগ পড়ছে। এই যে দাগগুলো ওয়াশরুমে যেতে চাইলে ওয়াশরুমে যেতে দিত না। অত্যাচার শুরু হয়ে যেত। এর মধ্যে একদিন এনে আঙ্গুলটাকে এভাবে প্লাস দিয়ে ধরছে। ধরার পর টেবিরের ওপর হাত রেখে প্লাস ধরে আর অন্য একজন সুঁই ঢুকায় আমার শরীরে। বলে- তুই আব্দুল মমিন না? আমি বলতাম- স্যার আমি আব্দুল মমিন না আমার নাম হলো হাবিব।