এডিবি-বিশ্বব্যাংকের এজেন্ডা বাস্তবায়নে এগোচ্ছে সরকার: ক্যাব

Bangla Post Desk
বাংলা পোস্ট প্রতিবেদক
প্রকাশিত:০৪ জুন ২০২৫, ০৫:২৮ পিএম
এডিবি-বিশ্বব্যাংকের এজেন্ডা বাস্তবায়নে এগোচ্ছে সরকার: ক্যাব
ছবি : সংগৃহীত

পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি (পিবিএস) ও পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) এর অভ্যন্তরীণ কোন্দল দীর্ঘদিনের। আরইবি ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগে পরস্পরের প্রতি দোষারোপ ও অস্থিরতা এখন চরমে। যা সমাধানে সরকার ব্যর্থ বলেই মনে হচ্ছে। অন্যদিকে সমস্যা সমাধান না করে বরং সমস্যার আগুনেই ঘি ঢেলে এডিবি-বিশ্বব্যাংকের এজেন্ডা বাস্তবায়নে এগোচ্ছে সরকার বলে জানিয়েছে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।

বুধবার (৪ জুন) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে বিশ্বব্যাংক ও এডিবির পরামর্শে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডকে (আরইবি) সেবা খাত থেকে বাণিজ্যিক খাতে রূপান্তরের প্রতিবাদে ও আরইবি-পিবিএসের মধ্যে বিদ্যমান বিবাদ অবসানে ক্যাবের সুপারিশ বাস্তবায়নের দাবিতে এক সংবাদ সম্মেলন এ কথা জানায় সংগঠনটি।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, ২০১০ সাল থেকেই দাতাগোষ্ঠী এডিবি ও বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী পল্লী বিদ্যুতায়ন খাতকে বেসরকারিকরণের যে ছবক দেওয়া হয়েছিল তা বাস্তবায়ন করতে পারেননি বিগত সরকারের প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক ই এলাহি চৌধুরী। তার রেখে যাওয়া দায়ই হয়তো কাঁধে তুলে নিতে হচ্ছে বর্তমান জ্বালানি উপদেষ্টাকে। এই পরিস্থিতির যখন সূত্রপাত হয়, তখন ক্যাবের পক্ষ থেকে একটা তদন্ত করা হয়। তদন্ত প্রতিবেদনের ফার্স্ট পার্ট ২০২৪ সালের ১০ ডিসেম্বর সরকারের কাছে জমা দেওয়া হলেও সেকেন্ড পার্ট দুর্নীতির অভিযোগ সংক্রান্ত তদন্ত ক্যাব স্থগিত রাখে। কারণ বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে ক্যাব প্রত্যাশিত সহযোগিতা পায়নি।

লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, বিগত সরকারের আমলে বিদ্যুৎ খাতের দুর্নীতির অংশ হিসাবে আরইবিতেও কেনাকাটা ও টেন্ডারসহ মাঠ পর্যায়ে হয়েছে নানা অনিয়ম। ক্যাবের প্রাথমিক ফাইন্ডিংসে, সেসব ধরা পড়ে। অতীতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় অ্যানার্জি খাতের দুর্নীতিকে উৎসাহিত করেছে। তারা এমনও দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তার কাছে চিঠি পাঠিয়ে তাকেই ব্যবস্থা নিতে বলেছে। এটি ভয়ংকর তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের দুর্নীতি নিয়ে মন্ত্রণালয় যা করেছে এবং এখনও যা করছে তা ভয়াবহ প্রহসন। পল্লী বিদ্যুৎ এ-পরিস্থিতির শিকার। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত মন্ত্রণালয় থেকে কোনো অভিযোগ দুদকে আসেনি। ক্যাব থেকে আসা অভিযোগ দুদক আমলে নিয়েছে।

তিনি বলেন, পল্লী বিদ্যুতায়ন খাত নিয়ে এডিবি-বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশন বাস্তবায়নে বিগত সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক ই ইলাহি চৌধুরী যেখানে ফেল করেছেন, তা সফল করার স্বপ্ন বর্তমান সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা দেখেন, এমন আশঙ্কা ক্যাব করে না। তাই ক্যাবের পক্ষ থেকে বর্তমান জ্বালানি উপদেষ্টাকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, বিশ্বব্যাংকের এই এজেন্ডা কখনই সফল করা যাবে না।

তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংক-এডিবির পরামর্শে সরকার যে পথে হাঁটতে চাইছে, সেটি বাস্তবায়িত হলে পল্লী বিদ্যুৎ খাত সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক খাতে পরিণত হবে। তাতে এ খাত অ্যানার্জি খাতের অন্যান্য সরকারি কোম্পানির অনুরূপ পরিণতি হবে। ওইসব কোম্পানি আকাশচুম্বী মুনাফা করছে। অথচ সেখানে আর্থিক ঘাটতি বাড়ছে। ঘাটতি মেটানোর কথা বলে বিদ্যুতের দাম বাড়নো হচ্ছে। পল্লী বিদ্যুতেও ব্যয় বাড়ছে। কোম্পানি হলে ব্যয় আরও বৃদ্ধি হবে। তাতে আর্থিক ঘাটতিও আরও বাড়বে। আর্থিক ঘাটতি মোকাবিলায় জ্বালানি আমদানি কমানো হয়, বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয় এবং বিদ্যুৎ আমদানিও বাড়ানো হয়।

তিনি বলেন, সরবরার করা মোট বিদ্যুতের প্রায় ৬০ শতাংশ ব্যবহার করে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে পল্লী বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যয়বৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ বাংলাদেশকে দ্রুত বিদ্যুৎ আমদানি বাজারে পরিণত করার ক্ষেত্রে পল্লী বিদ্যুতের ব্যয়বৃদ্ধি গুরুত্ব পাচ্ছে। এডিবি, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ-এর কাজ হচ্ছে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানির বাজারকে আমদানি বাজারে পরিণত করা। ভারতের ক্রসবর্ডার অ্যানার্জি ট্রেডিং পলিসি তারই প্রমাণ। তাই ক্যাব পল্লী বিদ্যুৎকে বাণিজ্যিকীকরণ করার উদ্দেশ্যে কোম্পানি করার মতো গণস্বার্থবিরোধী পদক্ষেপের সুস্পষ্টভাবে বিরোধিতা করছে।

তিনি বলেন, এডিবি ও বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ৮০’র দশক থেকে চলমান সংস্কারের উদ্দেশ্য প্রাইভেটাইজেশন। এই উদ্দেশ্যে লাভজনক করার জন্য রিস্ট্রাকচারিং এর নামে এখাত ভেঙে টুকরো টুকরো করে কোম্পানি বানিয়ে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। এই মন্ত্রণালয়ে এখন কমবেশি ৭৫টি কোম্পানি। প্রতিটা কোম্পানি লাভজনক এবং পর্যাপ্ত উদ্বৃত্ত অর্থের মালিক। ফিক্সড ডিপোজিটের মাধ্যমে কোম্পানিগুলো অর্থ বিনিয়োগ ব্যবসা করে। কোম্পানির বোর্ড চেয়ারম্যান ও সদস্য, কর্মচারী-কর্মকর্তা, ঠিকাদার এবং বিনিয়োগকারীরা অন্যায় ও অসম আর্থিক সুবিধা ও অতিরিক্ত কর্তৃত্ব ভোগ করে। অথচ ব্যাংক থেকে সুদে টাকা ধার নিয়ে কোম্পানি চালায়।

তিনি বলেন, পল্লী বিদ্যুৎ রিস্ট্রাকচারিং প্রস্তাব তারই ধারাবাহিকতা মাত্র। তাই ক্যাব এই প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছে। পল্লী বিদ্যুতের আলোচ্য সমস্যা অসমতা ও বৈষম্য। তা নিরসনের জন্য পল্লী বিদ্যুৎকে বাণিজ্যিক পণ্য বানাতে হবে এমন ধারণা অবাস্তব। এডিবি-বিশ্বব্যাংক এমন ভাবনা ভাবলেও সরকারের তেমন ভাবার সুযোগ নেই। যে সমস্যার একমাত্র সমাধান আরইবি-পিবিএসকে এক ও অভিন্ন চাকরি বিধির আওতায় আনা। ক্যাবের পক্ষ থেকে এমন সুপারিশই করা হয়েছে। তা উপেক্ষা করে এত জটিলতা সৃষ্টি কেন এমন প্রশ্ন তোলেন তিনি।

এ সময় তিনি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি এবং পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের চলমান সমস্যা নিরসনে ক্যাবের তদন্ত প্রতিবেদনে থাকা ৫ দফা সুপারিশ পুনরায় তুলে ধরেন। সেগুলো হলো—

১. বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আরইবি ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির চাকরিবিধি ভিন্ন হওয়ায় সমিতিগুলো কার্যত আরইবির অংশ নয় বরং অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান। ফলে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিতে কর্মরত কর্মকর্তা/কর্মচারীরা নানাভাবে বৈষম্যের শিকার হন বিধায় বিরোধ ও সংঘাত সৃষ্টি হয়। এই সংকটের স্থায়ী সমাধানের নিমিত্তে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড আইন, ২০১৩ এর ধারা ২(১০), ২৫ ও
২৬-এর আলোকে এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিভিল আপিল নং ৮২-৮৩/২০২১-এ প্রদত্ত রায়ের ভিত্তিতে আরইবি এবং পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জন্য এক ও অভিন্ন নিয়োগ, পদোন্নতি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নির্ধারণের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট চাকরি বিধি প্রণয়নের সুপারিশসহ সকল পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিকে জাতীয়করণ করার প্রস্তাব করা হয়।

২. পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির প্রতিটি অভিযোগকেন্দ্রে ন্যূনতম একজন ভোক্তা প্রতিনিধি নিয়োগ করতে হবে। ভোক্তা অভিযোগ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে ভোক্তা প্রতিনিধির দায়িত্ব ও ক্ষমতা সুনির্দিষ্ট হতে হবে এবং তা বিধি বা প্রবিধানে উল্লেখ থাকতে হবে।

৩. জাতীয়করণের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড আইন, ২০১৩ এর ধারা ৩১ এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিভিল আপিল নং ২২৭৬/২০২১-এ প্রদত্ত রায় বলবৎ থাকা অবস্থায় পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিগুলোতে কোনো সিবিএ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার সুযোগ সৃষ্টি হবে না বলে কমিটি মনে করে।

৪. বিদ্যুতের মূল্যহার বৃদ্ধি পাবে এমন সব (প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ) পদক্ষেপ বিবেচনার পূর্বে বিইআরসির মাধ্যমে গণশুনানির ভিত্তিতে (বাংলাদেশ অ্যানার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন, ২০০৩ এর ধারা ৩৪) ভোক্তা পক্ষের মতামত গ্রহণ ব্যতীত কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যাবে না।

৫. বাংলাদেশ অ্যানার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন, ২০০৩ এর ধারা ৪০ মতে আরইবির বিরুদ্ধে আনীত পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির অভিযোগসমূহ তথা আরইবি ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মধ্যে বিদ্যমান বিরোধ নিষ্পত্তি হতে পারে। ক্যাব এ-ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।

সংবাদ সম্মেলনে ক্যাব কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবির ভূঁইয়া, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মো. শওকত আলী খান, ক্যাবের সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মিজানুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।