দুধ-আনারস একসঙ্গে মানে মৃত্যু, নাকি এটা শুধুই মিথ?


বাড়ির বড়দের মুখে হয়তো শুনেছেন দুধ আর আনারস একসঙ্গে খেলে নাকি বিষক্রিয়া হয়! কারও কারও মতে, এর পরিণাম হতে পারে মৃত্যুও। ছোটবেলা থেকেই এমন সাবধানবাণী শুনে বড় হয়েছি আমরা অনেকেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো এই কথার পেছনে সত্যি কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে? নাকি এটা কেবলই পুরনো দিনের ভীতিকর এক ভ্রান্ত ধারণা? চলুন খুঁটিয়ে দেখা যাক দুধ আর আনারস একসঙ্গে খাওয়ার বিষয়টি।
গুজবের জন্ম কোথা থেকে?
দুধ ও আনারস একসঙ্গে খাওয়ার বিরুদ্ধে জনমনে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে বহু আগেই। আমাদের সমাজে প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, আনারসের সঙ্গে দুধ খেলে তা শরীরে ‘বিষ’ তৈরি করে। এই ‘বিষক্রিয়া’র ফলে পেটে ব্যথা, বমি, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে বলে বলা হয়। অনেক বাবা-মা এখনো সন্তানদের এই দুটো খাবার একসঙ্গে খেতে নিষেধ করেন। তবে প্রশ্ন হলো এই দাবির পেছনে কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে কি?
আনারস ও দুধের গঠনের পার্থক্য
পুষ্টিবিদদের মতে, আনারস একটি অ্যাসিডিক (অম্লীয়) ফল। এতে ব্রোমেলিন নামক একটি এনজাইম থাকে, যা প্রোটিন ভাঙতে সাহায্য করে। অন্যদিকে, দুধে থাকে প্রচুর প্রোটিন এবং ল্যাকটোজ।
আনারসে থাকা ব্রোমেলিন দুধের প্রোটিনকে ভেঙে দিতে পারে, ফলে দুধ জমে যেতে পারে বা জমাট বেঁধে যেতে পারে। এর ফলে কারও কারও হালকা পেটের অস্বস্তি বা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হতে পারে। তবে সেটা কখনোই ‘বিষক্রিয়া’ বা প্রাণঘাতী অবস্থার মতো কিছু নয়।
বিশেষজ্ঞদের মতামত কী বলছে?
বরগুনার বেতাগী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক মোস্তফা কামাল বলেন, ‘আসলে আনারস আর দুধ এক সঙ্গে খেলে কোনো সমস্যাই হয় না। আনারসে সাইট্রিক অ্যাসিড থাকে বলে খেতে কিছুটা টক লাগে। আর আনারসে ব্রোমেলেইন নামে একটি এনজাইম থাকে, যা দুধের ক্যাসিন নামক প্রোটিন ভেঙে ছানা বা দইয়ে পরিণত করতে পারে। এ ছাড়া তেমন কোনো সমস্যা হয় না।’
বারডেমের সাবেক প্রধান পুষ্টিবিদ আখতারুন নাহার গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘দুধ আর আনারস একসঙ্গে খেলে মানুষের মৃত্যু হয়-কথাটির বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি নেই। এটি নিতান্তই প্রচলিত কুসংস্কার।’যুক্তি হিসেবে তিনি কাস্টার্ডের কথা বললেন। এতে অন্যান্য ফলের সঙ্গে আনারস তো থাকেই, সঙ্গে থাকে দুধ। আবার আইসক্রিম কিংবা মিল্কশেকেও আনারসের সঙ্গে দুধ ব্যবহার করা হয় অহরহ। এসব খাবার খেলে মৃত্যু তো দূরে থাক, ছোটখাটো সমস্যার অভিযোগও কেউ করেছেন বলে শোনা যায় না।
এর ব্যখ্যা দিয়ে তিনি আরও বলেন, ফাইবার সমৃদ্ধ আনারস খাওয়ার কারণে অনেকের অ্যাসিডিটির সমস্যা দেখা দেয়। অন্যদিকে দুধে ল্যাকটোজেন নামের একটি উপাদান থাকে যা অনেকে হজম করতে পারে না। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে ল্যাকটোজেন অসহনশীলতা বলা হয়। অর্থাৎ এটা স্পষ্ট যে, এই সমস্যাগুলোও দুধ আর আনারস একসঙ্গে খাওয়ার ফলে হয় না। সমস্যাগুলো দেখা দেয় আমাদের শারীরিক কিছু সমস্যা বা সীমাবদ্ধতার কারণে।
বিজ্ঞান কী বলে?
বিশ্বখ্যাত হেলথ ও পুষ্টি প্ল্যাটফর্ম হেলথলাইন-এর মতে, দুধের সঙ্গে কিছু ফল যেমন লেবু, আনারস বা মাল্টা মেশালে দুধ জমাট বাঁধতে পারে। তবে এটাকে ‘বিষক্রিয়া’ বলা যায় না।
একই রকম তথ্য পাওয়া যায় হার্ভাড স্কুল অফ পাবলিক হেলথ-এর খাদ্যবিজ্ঞানী জন মেকেনারির গবেষণাতেও। সেখানে বলা হয়, ‘ফ্রুট অ্যাসিডস ক্যান কার্ডল মিল্ক, বাট দিস প্রোসেস ইজ নট টক্সিক। ইফ আ পারসন টলারেটস বথ মিল্ক অ্যান্ড দা ফ্রুট ইনডিভিজুয়ালি, দে ক্যান ইট দেম টুগেদার উইদআউট ফিয়ার।’ অর্থাৎ, দুধ ও ফল একসঙ্গে খেলে দুধ জমাট বাঁধলেও সেটা শরীরের জন্য ক্ষতিকর নয়, যদি ব্যক্তির সেসব খাবারের প্রতি অ্যালার্জি না থাকে।
তাহলে কোথা থেকে এতো ভয়?
এই ভ্রান্ত ধারণার উৎস সম্ভবত কিছু পুরনো ঘটনা, যেখানে মানুষ অসুস্থ হওয়ার পেছনে দুধ ও আনারসকে দোষারোপ করেছিল। সেই সময়গুলোতে খাদ্য নিরাপত্তা ও সংরক্ষণের যথাযথ ব্যবস্থা না থাকায় খাদ্য বিষক্রিয়া বা পেটের সংক্রমণ বেশি হতো, যা পরে ‘আনারস-দুধ মেশানো’ খাবারের দায়ে পড়ে যায়। এছাড়া, অনেকে শরীরগতভাবে স্পর্শকাতর হওয়ায় দুধ বা আনারসে সমস্যা অনুভব করেন এবং সেই সমস্যার সার্বজনীন ব্যাখ্যা হিসেবে গুজব ছড়িয়ে পড়ে।
কখন সতর্ক হওয়া প্রয়োজন?
কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে এই দুই খাবার একসঙ্গে খাওয়ার সময় সতর্ক থাকতে হবে-
>> যাদের ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স আছে তারা দুধ খেলে গ্যাস, ডায়রিয়া বা অস্বস্তি অনুভব করতে পারেন।
>> যাদের আনারসে অ্যালার্জি রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে ত্বকে চুলকানি, গলা ব্যথা বা শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
>> দীর্ঘক্ষণ রেখে দেওয়া আনারস-দুধ মিশ্রণ খেলে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ হতে পারে।
সত্যি নাকি মিথ?
সব দিক বিবেচনায় বলা যায়, দুধ-আনারস একসঙ্গে খেলে বিষক্রিয়া হয় এটা একেবারেই ভিত্তিহীন গুজব। সাধারণভাবে সুস্থ ব্যক্তির জন্য এই দুই খাবার একসঙ্গে খাওয়া একদম নিরাপদ। তবে অ্যালার্জি, সংবেদনশীল পেট বা খাদ্য সংরক্ষণের সমস্যা থাকলে হালকা সমস্যা হতে পারে। এখন সময় এসেছে গুজবের বদলে বিজ্ঞানকে গুরুত্ব দেওয়ার। ভয় নয়, খাবার বাছুন সচেতনভাবে।