জেনে নিন হামলার শিকার ইরানের ৩ পারমাণবিক স্থাপনা সম্পর্কে

Bangla Post Desk
বাংলা পোস্ট ডেস্ক
প্রকাশিত:২২ জুন ২০২৫, ০২:০৩ পিএম
জেনে নিন হামলার শিকার ইরানের ৩ পারমাণবিক স্থাপনা সম্পর্কে

ইরানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্য দিয়ে ইসরায়েল-ইরানের চলমান সংঘাতে জড়িয়ে পড়লেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

স্থানীয় সময় রবিবার (২২ জুন) ভোরে ফোরদো, ইসফাহান ও নাতাঞ্জের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক পোস্টে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প লেখেন, “আমরা ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় অত্যন্ত সফলভাবে হামলা পরিচালনা করেছি, যার মধ্যে রয়েছে ফোরদো, নাতাঞ্জ ও ইসফাহান।”

হামলার বিষয়টি ইরানের পারমাণবিক সংস্থা থেকেও নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে হামলা সত্ত্বেও ওই স্থাপনাগুলোর কার্যক্রম বন্ধ না করে বরং চালিয়ে যাওয়া হবে বলে দাবি করেছে তেহরান। নিচে ট্রাম্প ঘোষিত ইরানের তিনটি স্থাপনার বিবরণ ও এগুলোর পারমাণবিক কর্মসূচিতে গুরুত্ব তুলে ধরা হলো-

নাতাঞ্জ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ স্থাপনা

ইরানের মূল ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র নাতাঞ্জ। এটি রাজধানী তেহরান থেকে প্রায় ২২০ কিলোমিটার (১৩৫ মাইল) দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। এটি ইতোমধ্যে ইসরায়েলি বিমান হামলার শিকার হয়।

আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) জানায়, নাতাঞ্জে ইউরেনিয়াম ৬০% পর্যন্ত বিশুদ্ধ সমৃদ্ধ করা হয়েছিল। পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির আর মাত্র এক ধাপ পেছেনে ছিল এটি।

এই স্থাপনাটির একটি অংশ ইরানের সেন্ট্রাল প্লেটোর নিচে অবস্থিত, যা বিমান হামলা থেকে রক্ষার জন্য ভূগর্ভে নির্মিত। এখানে একাধিক সেন্ট্রিফিউজ ক্যাসকেড চালু রয়েছে, যা দ্রুত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে ব্যবহৃত হয়।

মূলত, একটি সেন্ট্রিফিউজ একা খুব অল্প পরিমাণ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে পারে। তাই ইউরেনিয়ামকে পর্যায়ক্রমে বেশি মাত্রায় সমৃদ্ধ করতে হলে অনেকগুলো সেন্ট্রিফিউজকে একটি ক্যাসকেড বা ধাপক্রমিক পদ্ধতিতে সাজাতে হয়।

আইএইএ জানিয়েছে, ইসরায়েলি হামলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন হওয়ার ফলে এসব সেন্ট্রিফিউজের বেশিরভাগই ধ্বংস হয়ে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া, ওই হামলাগুলোর ফলে তেজস্ক্রিয়তা কেবল সংশ্লিষ্ট স্থানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, আশপাশের এলাকায় ছড়ায়নি বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি।

ইরান এখন নাতাঞ্জের দক্ষিণ সীমানার ঠিক বাইরে অবস্থিত কুহ-ই কোলাং গাজ লা বা “পিকঅ্যাক্স পর্বতের” নিচে সুড়ঙ্গ খনন করছে।

এর আগেও স্টাক্সনেট ভাইরাসের লক্ষ্যবস্তু হয়েছিল নাতাঞ্জ। স্টাক্সনেট ভাইরাসটি ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি বলে ধারণা করা হয় এবং এটি ইরানি সেন্ট্রিফিউজ ধ্বংস করতে ব্যবহার করা হয়েছিল। এছাড়াও, ইসরায়েলের পরিচালিত দুটি পৃথক হামলার লক্ষ্যও ছিল এই স্থাপনাটি।

ফোরদো ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ স্থাপনা

তেহরান থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার (৬০ মাইল) দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত ফোরদো স্থাপনাটিতেও সেন্ট্রিফিউজ ক্যাসকেড রয়েছে, তবে এটি নাতাঞ্জের তুলনায় ছোট।

আইএইএ জানায়, ২০০৭ সালে এর নির্মাণকাজ শুরু হলেও যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এর অস্তিত্ব সম্পর্কে জানত। তবে ইরান এ বিষয়ে জাতিসংঘকে জানায় ২০০৯ সালে।

ফোরদো স্থাপনাটি একটি পাহাড়ের নিচে অবস্থিত এবং শক্তিশালী বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দ্বারা সুরক্ষিত।

সামরিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ ধরনের স্থাপনাকে কেবল “বাঙ্কার বাস্টার” বোমার মাধ্যমেই ধ্বংস করা সম্ভব, যেমন: যুক্তরাষ্ট্রের জিবিইউ-৫৭ এ/বি ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর বোমা। এই বোমাটি প্রায় ৩০ হাজার পাউন্ড (১৩ হাজার ৬০০ কেজি) ওজনের এবং এটি মাটির গভীরে প্রবেশ করে বিস্ফোরিত হয়, বিশেষ করে ভূগর্ভস্থ বাঙ্কার ও সুড়ঙ্গ ধ্বংসের জন্য তৈরি।

এই বোমাটি শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের বি-২ স্পিরিট স্টেলথ বোমারু বিমান থেকে নিক্ষেপযোগ্য, যা কেবল মার্কিন বিমান বাহিনী পরিচালনা করে এবং নর্থরপ গ্রুম্যান এটি উৎপাদন করে থাকে। এর মানে, যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সম্পৃক্ততা ছাড়া এমন অভিযান পরিচালনা সম্ভব নয়।

ইসফাহান পারমাণবিক প্রযুক্তি কেন্দ্র

তেহরান থেকে প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার (২১৫ মাইল) দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত ইসফাহান স্থাপনাটিতে হাজার হাজার পরমাণু বিজ্ঞানী কাজ করেন। এখানে একই সঙ্গে তিনটি চীনা গবেষণা চুল্লি এবং ইরানের পরমাণু কর্মসূচি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গবেষণাগারও রয়েছে।

ইসফাহানে অবস্থিত পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপরও হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল, যার মধ্যে রয়েছে ইউরেনিয়াম রূপান্তর কেন্দ্র।

আইএইএ জানায়, সেখানেও কোনো ধরনের তেজস্ক্রিয়তা বৃদ্ধির লক্ষণ দেখা যায়নি।

আরও কিছু পারমাণবিক স্থাপনা

ইরানের পরমাণু কর্মসূচিতে আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রয়েছে, যেগুলোর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের হামলা চালানোর খবর পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে রয়েছে বুশেহরে অবস্থিত ইরানের একমাত্র বাণিজ্যিক পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। পারস্য উপসাগরের তীরে তেহরান থেকে ৭৫০ কিলোমিটার (৪৬৫ মাইল) দক্ষিণে অবস্থিত এটি। সেখানে আরও দুটি চুল্লি নির্মাণাধীন।

এই চুল্লিগুলো রাশিয়ায় উৎপাদিত ইউরেনিয়াম দিয়ে পরিচালিত হয় এবং আইএইএয়ের নজরদারির আওতায় রয়েছে। এছাড়া, তেহরান থেকে ২৫০ কিলোমিটার (১৫৫ মাইল) দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত আরাক হেভি ওয়াটার রিয়্যাক্টর। এই চুল্লিটি পারমাণবিক রিয়্যাক্টর ঠান্ডা করতে হেভি ওয়াটার ব্যবহার করে।

হেভি ওয়াটারের (Heavy Water) রাসায়নিক নাম ডিউটেরিয়াম অক্সাইড (D₂O)। সাধারণ পানিতে (H₂O) হাইড্রোজেনের দুটি পরমাণু থাকে, যেগুলো সাধারণত প্রোটিয়াম নামে পরিচিত, যা হাইড্রোজেনের সবচেয়ে হালকা আইসোটোপ।

অন্যদিকে, ভারি পানিতে এই হাইড্রোজেন পরমাণুগুলোর বদলে থাকে ডিউটেরিয়াম, যা হাইড্রোজেনের একটি ভারী আইসোটোপ। ডিউটেরিয়ামের পরমাণু ভর সাধারণ হাইড্রোজেনের চেয়ে দ্বিগুণ। এজন্য D₂O দেখতে পানির মতো হলেও এর ঘনত্ব, গলনাঙ্ক ইত্যাদি আলাদা। ভারী পানি পরমাণু চুল্লিতে নিউট্রন মডারেটর হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

তাছাড়া রয়েছে তেহরান গবেষণা চুল্লি। এটি ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থার সদর দপ্তরে অবস্থিত। এটি প্রাথমিকভাবে উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের ওপর নির্ভরশীল ছিল, তবে প্রসারণ-সংক্রান্ত উদ্বেগ মোকাবিলায় পরবর্তীতে কম সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামে রূপান্তর করা হয়।

এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের এই হামলা ইরানের পরমাণু কর্মসূচিতে গুরুত্বপূর্ণ ধাক্কা হলেও, এটি মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ বিস্তারের আশঙ্কাও বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে, যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে।