সাদা ধোঁয়ায় কার নাম ভাসবে ফ্রান্সিসের উত্তরসূরি হিসেবে?


পোপ ফ্রান্সিসের উত্তরসূরি কে হচ্ছেন তা নিয়ে এখন বেশ আলোচনা চলছে। সম্ভাব্য প্রার্থীদের নামও আসছে সামনে। নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের শীর্ষ এই ধর্মীয় গুরু নির্বাচন করা হবে। বাংলাদেশ সময় সোমবার (২১ এপ্রিল) ৮৮ বছর বয়সে পোপ ফ্রান্সিস মারা যাওয়ার বিষয়টি ঘোষণা করে ভ্যাটিকান। এরপর বিশ্বব্যাপী পরবর্তী পোপ নির্বাচন নিয়ে চলছে আলোচনা।
পোপ হিসেবে ১২ বছর দায়িত্ব পালনের পর মৃত্যু হয় ফ্রান্সিসের। ক্যাথলিক চার্চের নতুন নেতা কে হবেন, তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। ১৩৯ কোটি ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা এই পোপ।
কে হচ্ছেন পরবর্তী পোপ?
এখনো উত্তরসূরি নির্বাচন হয়নি। পোপ নির্বাচনের জন্য কলেজ অফ কার্ডিনালস রয়েছে। এতে জ্যেষ্ঠ ক্যাথলিক পাদ্রিদের অনেককেই নিযুক্ত করেছেন সম্প্রতি মারা যাওয়া পোপ ফ্রান্সিস নিজেই। যারাই মূলত পরবর্তী পোপ নির্বাচন করবেন।
তবে পোপ হওয়ার জন্যও পূরণ করতে হবে কিছু শর্ত। এর মধ্যে একজন প্রার্থীকে অবশ্যই হতে হবে ব্যাপ্টিস্ট ও রোমান পুরুষ ক্যাথলিক। যদিও এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে কার্ডিনালরা শতাব্দী ধরে তাদের পদ থেকে এককভাবে কাউকে নির্বাচিত করে আসছেন।
সারা বিশ্বে বর্তমানে ২৪০ জনেরও বেশি কার্ডিনাল রয়েছেন। তারা সাধারণত আজীবন এই পদবি ধারণ করে থাকেন।
কিভাবে নতুন পোপ নির্বাচন হবে?
রীতি অনুযায়ী পোপের মৃত্যু হলে বা পদত্যাগ করলে ৮০ বছরের কম বয়সী কার্ডিনালরা পোপ সম্মেলনে ভোট দেন। বাইরের প্রভাবমুক্ত রাখার জন্য পোপদের সম্মেলনটি সিস্টিন চ্যাপেলে সীমাবদ্ধ রাখা হয়। যেখানে সম্ভাব্য পরবর্তী পোপের বিষয়ে আলোচনা করেন কার্ডিনালরা।
পোপ নির্বাচনের জন্য সাধারণত ভোটার সংখ্যা ১২০ জনে সীমাবদ্ধতা থাকলে বর্তমানে যোগ্য ভোটার হিসেবে রয়েছেন ১৩৮ জন। ভোটাররা গোপন ব্যালটে পোপ নির্বাচনে ভোট দিয়ে থাকেন। আর এই নির্বাচন প্রক্রিয়াটি পর্যবেক্ষণ করে থাকেন ৯ জন কার্ডিনাল। তবে ঐতিহ্যগতভাবে পোপ নির্বাচনের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ ভোটের প্রয়োজন হয়। তবে এই শর্ত পূরণ না হওয়া পর্যন্ত ভোটের কার্যক্রম কয়েক পর্বে অব্যাহত থাকে।
নির্বাচন প্রক্রিয়ায় প্রতিটি পর্বে ব্যালট কেমিক্যাল দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়। এসময় কালো বা সাদা ধোঁয়া তৈরি হয়। যেটি মূলত ফলাফলের সংকেত দেয় বিশ্ববাসীকে। এরমধ্যে কালো ধোঁয়া সংকেত দেয় যে সিদ্ধান্ত হয়নি। আর সাদা ধোঁয়া সংকেত দেয় সিদ্ধান্ত হয়েছে। সর্বশেষ পোপ নির্বাচিত হওয়ার পর একজন শীর্ষ কার্ডিনাল সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকা থেকে নতুন পোপের নাম ঘোষণা করেন।
কখন শুরু হবে পোপ নির্বাচনের সম্মেলন?
পোপের মৃত্যু বা পদত্যাগের দুই বা তিন সপ্তাহ পর সাধারণত পোপ নির্বাচনের সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। পোপের মৃত্যুর পর নয়দিন শোক পালন করা হয়। এই সময়ের মধ্যে বিশ্বজুড়ে থাকা কার্ডিনালরা ভ্যাটিকানে আসেন।
২০১৩ সালের পোপ সম্মেলনে ফ্রান্সিসকে পোপ নির্বাচন করা হয়। তিনি দক্ষিণ আমেরিকা থেকে নির্বাচিত প্রথম পোপ। ষোড়শ পোপ বেনেডিক্টের পদত্যাগের মাত্র ১২ দিন পর তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
কত সময় লাগে নতুন পোপ নির্বাচনে?
নতুন পোপ নির্বাচনে কতটা সময় লাগবে তা নির্ভর করে কার্ডিনালদের বিভক্তির ওপর। এই প্রক্রিয়াটি সম্পাদন করতে একদিন বা এক সপ্তাহ এমনকি তারও বেশি সময় প্রয়োজন হতে পারে।
প্রতিদিন সম্মেলনে পোপ নির্বাচনের জন্য চার দফা ভোট দিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করবেন কার্ডিনালরা। ৩৩টি পর্বে ভোটগ্রহণেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হলে শীর্ষ দুই প্রার্থী দ্বিতীয় দফার ভোটে মুখোমুখি হবেন।
সর্বশেষ তিনটি পোপ নির্বাচনে তুলনামূলক কম সময় লেগেছে। এই নির্বাচনগুলোতে মাত্র কয়েক দিন লেগেছে। তবে পোপ নির্বাচনে দীর্ঘ সময় লাগারও ইতিহাস রয়েছে। রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে ১২৭১ সালে পোপ গ্রেগরি দশমকে নির্বাচন করতে সময় লেগেছিল তিন বছর।
পরবর্তী পোপ নির্বাচনের জন্য শীর্ষ প্রার্থী যারা
প্রয়াত পোপ ফ্রান্সিস পরবর্তী পোপ নির্বাচনের জন্য পোপ নির্বাচন পরিষদের ১৩৮ সদস্যের মধ্যে ১১০ জন কার্ডিনালকে মনোনীত করেছেন। এসব কার্ডিনাল ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় অবস্থান করছেন, যা আগের নির্বাচকদের তুলনায় বেশি বৈচিত্র্যময়।
সারা বিশ্ব থেকে কার্ডিনাল মনোনয়ন পোপ ফ্রান্সিসের বিশ্বব্যাপী চার্চের সম্প্রসারণ নীতিকে তুলে ধরে। সবচেয়ে কম বয়সী কার্ডিনালের বয়স ৪৫ বছর, যিনি অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসকারী একজন ইউক্রেনীয় ধর্মযাজক।
এর ফলে এমন সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে যে, এবার শতাব্দীর পর প্রথমবারের মতো পরবর্তী পোপ আফ্রিকা, এশিয়া অথবা অন্য কোনো অঞ্চল থেকে নির্বাচিত হতে পারে, নিতে পারে গির্জার নেতৃত্ব।
পিটার তুর্কসন (ঘানা)
তুর্কসন আফ্রিকার প্রভাবশালী কার্ডিনালদের মধ্যে শীর্ষ একজন। তিনি জাস্টিস অ্যান্ড পিসের পন্টিফিকাল কাউন্সিলের সাবেক প্রধান। এছাড়া তিনি কঙ্গোর গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের ফ্রিডোলিন অ্যাম্বোঙ্গো, কিনশাসার আর্চবিশপ। অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার, পরিবেশগত সমস্যা এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তিনি কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। জাতিসংঘে আফ্রিকান জনগণের অধিকার নিয়েও কথা বলেছেন তিনি।
লুইস আন্তোনিও ট্যাগলে (ফিলিপাইন)
আরেকজন শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দী প্রার্থী হলেন ফিলিপাইনের প্রাক্তন আর্চবিশপ ট্যাগলে পোপ। যিনি ফ্রান্সিসের বিশেষ পরামর্শদাতা ছিলেন। লাতিন আমেরিকার ক্যাথলিকদের জন্য তার ভূমিকার জন্য পরিচিত তিনি। তিনি ধর্মীয় অসাম্প্রদায়িকতা ও সামাজিক ন্যায়বিচার এবং দরিদ্রদের প্রতি যত্ন নেওয়ার ওপর জোর দেন।
পিটার এর্দো (হাঙ্গেরি)
শীর্ষস্থানীয় রক্ষণশীল প্রার্থী হিসেবে দেখা হয় হাঙ্গেরীয় কার্ডিনাল পিটার এর্দোকে। তিনি পূর্ব খ্রিষ্টানদের মধ্যে সম্পর্কের সেতু হিসেবে কাজ করতে পারেন। তিনি আইন এবং ধর্মীয় তত্ত্বে বিশেষজ্ঞ এবং পোপ ফ্রান্সিসের একজন ঘনিষ্ঠ পরামর্শদাতা ছিলেন।
তিনি একটি আধুনিক গির্জার পক্ষে কাজ করছেন এবং সমকামীদের বিরুদ্ধে পোপের অবস্থান নিয়ে আলোচনা করেছেন। এসটারগম-বুদাপেস্টের আর্চবিশপ এরদো ঐতিহ্যবাদী অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের কাছে পৌঁছানোর পক্ষে ছিলেন এবং গির্জার মধ্যে ঐক্যের ‘ব্যাপক প্রয়োজনের’ ওপর জোর দিয়েছিলেন।
পিয়েত্রো প্যারোলিন (ইতালি)
এই তালিকায় রয়েছেন দীর্ঘ সময় ধরে ভ্যাটিকান সরকারের প্রধান হিসাবে কাজে নিযুক্ত পিয়েত্রো প্যারোলিন। পোপ ফ্রান্সিসের সেক্রেটারি অব স্টেট হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন ইতালির এই কার্ডিনাল। শীর্ষ কূটনৈতিক দক্ষতার জন্য তিনি সকল কার্ডিনালের কাছে পরিচিত। তিনি বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছেন এবং ভ্যাটিকানের কূটনৈতিক কার্যক্রমে প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন।
তার কূটনৈতিক দক্ষতার কারণে ২০১৩ সালে পোপ ফ্রান্সিস তাকে এই পদে নিযুক্ত করেন। কূটনীতি, প্রশাসন এবং বিশ্ব রাজনীতি সম্পর্কে গভীর অভিজ্ঞতা তাকে পোপ হওয়ার জন্য একটি শক্তিশালী প্রার্থী করে তুলেছে।
ম্যাটেও মারিয়া জুপ্পি (ইতালি)
পোপ ফ্রান্সিসের উত্তরসূরি হওয়ার দৌড়ে অন্যান্য প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন ইতালির কার্ডিনাল বোলোগনার আর্চবিশপ ম্যাটেও মারিয়া জুপ্পি। ক্যাথলিক সমাজে একটি প্রগতিশীল কণ্ঠস্বর, বিশ্ব শান্তির জন্য পোপ ফ্রান্সিসের বিশেষ শান্তির দূত হিসেবে ইউক্রেনে নিযুক্ত হয়েছেন এই কার্ডিনাল। তিনি বিশেষত সেন্ট’ইজিডিও রোমান সম্প্রদায়ের সদস্য এবং অভিবাসী ও সমকামী ক্যাথলিকদের জন্য তার ভূমিকার জন্য সুপরিচিত। গত কয়েক বছরে ইউরোপীয় শান্তি ও মানবাধিকার বিষয়ে তার দৃঢ় অবস্থান রয়েছে।
এছাড়াও বিশপদের সিনডের মহাসচিব ও মাল্টার কার্ডিনাল মারিও গ্রেচ শীর্ষ প্রার্থীদের তালিকায় রয়েছেন।
পোপ নির্বাচনের সময় ভ্যাটিকানের কী হবে?
নতুন পোপ নির্বাচিত হওয়ার আগ পর্যন্ত ভ্যাটিকানের সাময়িকভাবে আর্থিক ও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করবেন একজন জ্যেষ্ঠ কার্ডিনাল। যাকে বলা হয় ক্যামারলেঙ্গো। ক্যামারলেঙ্গো মূলত পোপ মারা যাওয়ার পর কিংবা পদত্যাগের পর নতুন পোপ নির্বাচিত হওয়ার আগ পর্যন্ত সময়কালে ভ্যাটিকানের দায়িত্ব পালন করাকে বোঝায়। চার্চের মতবাদ বা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এই ক্যামারলেঙ্গোর থাকে না।
বর্তমান ক্যামারলেঙ্গো হলেন আয়ারল্যান্ডের বংশোদ্ভুত কার্ডিনাল কেভিন ফারেল। তিনি ভ্যাটিকানের সুপ্রিম কোর্টের প্রেসিডেন্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।