পুষ্পা: দ্যা রুল
সংলাপ, অ্যাকশন, গান ও বৈচিত্র্যপূর্ণ গল্পের পরিবেশনে সর্বদাই আলাদা আবেদন থাকে দক্ষিণ ভারতীয় মুভিগুলোতে। চলচ্চিত্র মুক্তির প্রতিটি উৎসবমুখর মৌসুমে তারই প্রমাণ মেলে কলিউড, টলিউড, মলিউড ও স্যান্ডালউড জুড়ে। সেখানে যদি আবার ভারতের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিকপ্রাপ্ত নায়ক আল্লু অর্জুনের ছবির কথা আসে, তাহলে স্বভাবতই প্রত্যাশা আরও একটু বেড়ে যায়। সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে তার রেকর্ড সৃষ্টিকারী সিনেমা ‘পুষ্পা: দ্যা রাইজ’-এর সিকুয়াল ‘পুষ্পা: দ্যা রুল’। এরই মধ্যে শিরোনামটির পাশে যুক্ত হয়েছে পাহাড় সমান উপার্জনের অংক। চলুন, এ পর্যন্ত পুষ্পা-২ চলচ্চিত্রটির মোট উপার্জন এবং পর্দার সামনের ও পেছনের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া জেনে নেওয়া যাক।
পুষ্পা-২ চলচ্চিত্র বৃত্তান্ত
তেলেগু ভাষার ছবিটির রচনা ও পরিচালনায় ছিলেন সুকুমার। সুকুমার রাইটিংস ও মিথ্রি মুভি মেকার্স প্রযোজিত চলচ্চিত্রটির সংলাপ রচনা করেছেন শ্রীকান্থ ভিস্সা। পুষ্পা ফ্যাঞ্চাইজির এই দ্বিতীয় কিস্তিটি ‘পুষ্পা: দ্যা রাইজ’ (২০২১)-এর সিক্যুয়াল। নাম ভূমিকায় আল্লু অর্জুনের পাশাপাশি প্রধান নারী চরিত্রে যথারীতি অভিনয় করেছেন রাশ্মিকা মন্দানা। অন্যান্য ভূমিকায় আছেন ফাহাদ ফাসিল, জগপতি বাবু, রাও রমেশ, সুনীল এবং অনসূয়া ভরদ্বাজ।
বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে ছিল ধনঞ্জয়ের ক্যামিও। গত ৫ ডিসেম্বর ছবিটি ভারতসহ সারা বিশ্বে মুক্তি পায়।
ভারতীয় বক্স অফিসে পুষ্পা-২
ভারতের সবচেয়ে ব্যয়বহুল চলচ্চিত্রগুলোর তালিকায় স্থান পাওয়া এই ছবিটির নির্মাণ বাজেট ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি রুপি। বাংলাদেশি টাকায় এই বাজেট ৫৬৫ কোটি থেকে ৭০৬ কোটি টাকা (১ রুপি = ১ দশমিক ৪১ বাংলাদেশি টাকা)।
আর উপার্জনের দিক থেকে চলচ্চিত্রটির বিস্ময়কর অবস্থান জন্ম দিয়েছে বিপুল উত্তেজনার। মুক্তির আগেই এটি ভারতে সর্বোচ্চ প্রি-রিলিজ ব্যবসার রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। এর মধ্যে থিয়েট্রিকাল ও নন-থিয়েট্রিকাল ব্যবসা থেকে সর্বমোট আয় ছিল ১ হাজার ৮৫ কোটি রুপি (১ হাজার ৫৩২ কোটি টাকা)।
এর মধ্যে ২০০ কোটি রুপি (২৮২ কোটি টাকা) উঠেছে হিন্দি ডাব্ড ডিস্ট্রিবিউশন স্বত্ত্ব থেকে। ভারতের বাইরে গোটা বিশ্ব থেকে আয় হয়েছে ১৪০ কোটি রুপি (১৯৭ কোটি টাকা)। ডিজিটাল, স্যাটেলাইট এবং সঙ্গীত স্বত্ত্ব থেকে আয় হয়েছে মোট ৪২৫ কোটি রুপি (৬০০ কোটি টাকা)।
কেবল অগ্রিম টিকেট বুকিং থেকেই বিশ্বব্যাপি আয় হয়েছে ১০০ কোটি রুপি (১৪১ কোটি টাকা)। এভাবে অগ্রিম বিক্রি করা টিকেটের সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। ছবিটি ‘বুকমাইশো’-তে প্রথম ১০ লাখ টিকেট বিক্রিতে দ্রুততম চলচ্চিত্র হওয়ার রেকর্ড স্থাপন করেছে।
আর মুক্তির পর প্রথম দিনেই মুভিটি বিশ্বজুড়ে ২৮০ কোটি রুপি (৩৯৫ কোটি টাকা) আয়ের মাধ্যমে সর্বোচ্চ উপার্জনকারী ভারতীয় চলচ্চিত্রের রেকর্ডটি দখল করে নেয়। রবিবার, চতুর্থ দিনে (৯ই ডিসেম্বর) ভারতে ১৪১.৫০ কোটি টাকা আয় করেছে পুষ্পা-২ ছবিটি।
পুষ্পা-২ সিনেমা ঘিরে যত প্রতিক্রিয়া
গত ৪ ডিসেম্বর হায়দ্রাবাদের সন্ধ্যা হলে মুভি চলার সময় এক নারী তার ছোট ছেলেসহ দুর্ঘটনাবশত ভিড়ের মধ্যে মাটিতে পড়ে যান। এতে পায়ের নীচে চাপা পড়ে ছোট ছেলেটি গুরুতরভাবে আহত হয় আর নারীটি মারা যান। এতে আল্লু অর্জুনসহ গোটা ফিল্মের ইউনিট, হল মালিক ও অর্জুনের নিরাপত্তা দলের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। অর্জুনের টিম ছেলেটিকে সবরকম সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেয়।
এর আগে মুক্তির কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অনলাইন পাইরেসির শিকার হয় সিনেমাটি। এটি বিনামূল্যে ডাউনলোডের জন্য বেশ কয়েকটি পাইরেসি ওয়েবসাইটে উন্মুক্ত হয়ে যায়। এগুলোর মধ্যে ছবিটির ন্যূনতম ২৪০ পিক্সেল থেকে ১ হাজার ৮০ পিক্সেলের এইচডি প্রিন্ট পর্যন্ত একাধিক রেজোলিউশন অন্তর্ভূক্ত ছিল। এর ফলে রোষানলে পড়ে চলচ্চিত্রটির উচ্চ মূল্যের টিকিট এবং সেই সঙ্গে বক্স অফিস সাফল্য। পরবর্তীতে রাজনৈতিক সমর্থনে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়।
এছাড়াও মুভিটির কিছু বানোয়াট সংলাপ সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সংলাপগুলোর রচয়িতা হিসেবে নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তির নাম দাবি করা হয়, যারা কোনোভাবে এই মুভির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না। এই মিথ্যাচার বন্ধের লক্ষ্যে মিথ্রি মুভি মেকার্স তাদের অফিসিয়াল এক্স (সাবেক টুইটার)-এর মাধ্যমে কঠোর সতর্কতা জারি করে।
বক্স অফিসের প্রভাব কতটুকু ছিল সিনেমার পর্দায়
পরিচালনা
৩ ঘণ্টা ২০ মিনিটের এই চলচ্চিত্রটি স্থান পেয়েছে এখন পর্যন্ত নির্মিত ভারতের দীর্ঘতম পূর্ণদৈর্ঘ্য মুভিগুলোর তালিকায়। এই বিস্তৃত পরিসরের পরিবেশনার প্রধান দিক ছিল পরিচালক সুকুমারের নৈপুণ্য। তিনি এখানে সামাজিক আবহের সঙ্গে সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন চিত্তাকর্ষক বিনোদনের। চিত্রনাট্যের বুননে ছিল আবেগ, অ্যাকশন এবং চক্রান্তের ভারসাম্যপূর্ণ নাট্যরূপ। গ্রহণযোগ্য গতিশীলতার কারণে দীর্ঘ পরিসরের দৃশ্যায়নগুলোর প্রতিটি অংশ ছিল মনোযোগ ধরে রাখার মতো।
শুধু পুষ্প রাজ-ই নয়, বনওয়ার শিং শেখাওয়াতসহ অন্যান্য পার্শ্ব চরিত্রগুলোকেও তিনি প্রাণবন্ত রেখেছেন সূক্ষ্ম রসবোধের মাধ্যমে। প্রতিটি চরিত্র নিজের স্বতন্ত্র পরিচয় নিয়ে ধরা দিয়েছে পূর্ণদৈর্ঘ্য ফ্রেমে। এমনকি শেষের দিকে পুষ্পার আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক দ্বন্দ্বের দৃশ্যায়নটিও ছিল বেশ সন্তোষজনক এবং উপভোগ্য।
অভিনয়
এই সিনেমার মধ্য দিয়ে আরও একটি সেরা পারফরম্যান্সের কারণে নতুন এক মাত্রা পেলো অর্জুনের ফিল্ম ক্যারিয়ার। বেশ কিছু সফল মুভির নায়ক হওয়ায় তাকে ঘিরে ভক্তদের প্রত্যাশা বরাবরই বেশি। এবারেও তাদের হতাশ হতে হয়নি। বিশেষ করে জাতারার দৃশ্যগুলো ছিল দুর্দান্ত, যার রেশ থেকে যাবে অনেকটা সময় ধরে। তার অভিব্যক্তি, বাচনভঙ্গি ও অঙ্গভঙ্গিমাকে দর্শকদের উচ্ছ্বাসের পর্যায়ে নিয়ে যেতে অবদান রেখেছে ছবির কোরিওগ্রাফি, ভিজ্যুয়াল ও সম্পাদনা। ফলশ্রুতিতে, অর্জুন যে কেবল টলিউডের নন, গোটা ভারতের একজন তুখোড় অভিনয়শিল্পী তা আবারও প্রতিষ্ঠা পেলো।
অপরদিকে গল্পের শ্রীভাল্লিকে নিছক পার্শ্বচরিত্র থেকে গল্পের প্রাণকেন্দ্রে নিয়ে গেছেন রশ্মিকা মন্দানা। তার সংবেদনশীল উপস্থাপনা পুষ্পা চরিত্রসহ গোটা সিনেমাকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। পুষ্প-শ্রীভাল্লির রসায়ন, বিশেষত তাদের ‘পেপি নাম্বার পিলিংস’ পরিবেশনা আরও একবার জানান দিলো পুষ্পা ফ্র্যাঞ্চাইজির স্বকীয়তা।
ফাহাদ ফাসিল কেবল একজন খল নায়কই নন, তার অদ্ভূত হুমকি এবং উদাসীনতা অব্যাহত রেখেছে মুভির বৈচিত্র্য। মারদাঙ্গা চলচ্চিত্র মানেই যে শক্তিশালী ও ভীতিকর প্রতিপক্ষ, তারই উন্মুক্ত প্রকাশ ঘটেছে চলচ্চিত্র জুড়ে।
প্রযুক্তিগত সংযোজন ও কারিগরি দিক
প্যান ভারতীয় মুভির অগ্রগতির এক অন্যতম দৃষ্টান্ত হচ্ছে ‘পুষ্পা দ্যা রুল’। সাম্প্রতিক হাইটেক মুভিগুলোর মতো এখানেও দৃশ্যমান ছিল প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ। এই কারিগরি দিকটি কিছুটা হলেও এই কিস্তিকে এগিয়ে দিয়েছে প্রথমটা থেকে। মিরোস্ল কুবা ব্রোজেক-এর দক্ষ সিনেমাটোগ্রাফিতে অত্যন্ত সুক্ষ্মভাবে প্রকাশ পেয়েছে গহীন বন, সরব ও নিরবতার বৈচিত্র্যপূর্ণ দৃশ্যপট। এক দৃশ্য থেকে অন্য দৃশ্যে রূপান্তরগুলো ছিল বিরামহীন।
সংগীতায়োজন
ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর প্রথম মুভিটির সঙ্গে দ্বিতীয়টির যথেষ্ট সঙ্গতি রেখেছে। এর একটা বিরাট কৃতিত্ব হচ্ছে দেবী শ্রী প্রসাদের সংগীতায়োজনের। ‘সুসেকি’ ও ‘কিসিকি’ গান দুটো যেন এক গল্পের মধ্যেই আরও দুটো পূর্ণাঙ্গ গল্প বলার প্রয়াস।
দৃষ্টিগোচর বিচ্যুতি
যে রচনার উপর দাঁড়িয়ে গোটা চলচ্চিত্র, সেখানে ছিল না কোনো বৈচিত্র্য। বর্তমান সময়ের অন্যান্য প্যান ভারতীয় ক্রাইম থ্রিলারগুলোর সঙ্গে আলাদা করে নতুন কিছুর সংযোজন ঘটাতে পারেনি মুভির স্ক্রিপ্ট। উপরন্তু, মুখোমুখি দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ত্রুটিপূর্ণ অংশগুলো বেশ চোখে পড়ার মতো, যা এত বড় বাজেটের একটি ছবির জন্য একদমই অনুচিত।
শেষাংশ
আল্লু অর্জুনের পুষ্পা-২ নিয়ে হইচই-এর মূল ইন্ধন যুগিয়েছে মূলত হায়দ্রাবাদের হলে নারীর মৃত্যু এবং মুক্তির ঘণ্টখানেকের মধ্যে পাইরেসির ঘটনা। এতে উদাত্ত নেতিবাচক প্রচার পেলেও ছবির প্রতি ভক্তদের প্রত্যাশাটা ছিল অনেক আগে; সেই পুষ্পা-১ দেখার পর থেকে। তারই প্রমাণ মিলেছে সাড়া জাগানো বক্স অফিস রেকর্ডের মাধ্যমে, যে সাফল্য কোনো কিছুতেই দমিয়ে রাখা যায়নি। তবে এত বড় বাজেটের একটি অ্যাকশন মুভি হিসেবে গল্প ও অ্যাকশন সিকুয়েন্সে প্রথম কিস্তিকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি।