সিনেমা থেকে যেভাবে রাজনীতিতে উত্থান থালাপতির


তামিলনাড়ুর রাজনীতি নিয়ে আলোচনা শুরু হলে একটি বিষয় প্রায়ই সামনে আসে। এখানে রাজনীতির সঙ্গে সিনেমার সংযোগ অবিচ্ছেদ্য। কয়েক দশক ধরে তামিল চলচ্চিত্রশিল্প শুধু বিনোদনের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং রাজনীতির মঞ্চে প্রভাব বিস্তার করেছে। এম.জি. রামচন্দ্রন (এমজিআর), জে. জয়ললিতা কিংবা করুণানিধি মুথুবেলের মতো নেতাদের উত্থানও হয়েছিল সিনেমা ও গণআন্দোলনের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে। এই ধারাবাহিকতায় সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে আলোচিত নাম হলেন থালাপতি বিজয়।
অভিনয়ের শুরু
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ছোটবেলা থেকেই অভিনয়ের প্রতি বিজয়ের প্রবল আগ্রহ ছিল। ১৯৮৪ সালে পি.এস. ভীরাপ্পা প্রযোজিত ‘ভেত্রি’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে শিশুশিল্পী হিসেবে সিনেমা জগতে পা রাখেন, তখন তার বয়স মাত্র ১০ বছর।
পরবর্তী সময়ে বিজয় শিশুশিল্পী হিসেবে কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করেন। ১৯৮৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘নান সিগাপ্পু মানবন’ ছবিতে তিনি কিংবদন্তি রজনীকান্তের সঙ্গে পর্দা ভাগাভাগি করেন।
বিজয় তার ১৮ বছর বয়সে ‘নালাইয়া থির্পু’ (১৯৯২) ছবিতে প্রথমবারের মতো মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেন। এরপর তিনি অভিনয় করেন ‘সেন্থুরাপান্ডি’, ‘রাসিগান’, ‘দেবা’ ও ‘কোয়েম্বাটুর মাপ্পিল্লাই’ সিনেমাতে, যা সবই ব্যবসায়িকভাবে সফল হয়।
২০০৩ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে বিজয় দৃঢ়ভাবে নিজেকে তামিল চলচ্চিত্রের প্রধান নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। ২০০৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘তিরুমালাই’ সিনেমা ঘরোয়া বক্স অফিসে ৫০ কোটি রুপির বেশি আয় করে ও মুক্তির প্রথম সপ্তাহেই সর্বাধিক দর্শক অর্জনের রেকর্ড গড়ে।
ক্রমে বিজয় আকাশছোঁয়া তারকাখ্যাতি পেতে শুরু করেন। তার সিনেমার টিকিট কিনতে ভক্তরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন দেন। বিজয়ই ভারতের প্রথম অভিনেতা, যিনি একটি ছবির জন্য ২০০ কোটি রুপি পারিশ্রমিক গ্রহণ করেন।
প্রযোজক অর্চনা কালপাঠি এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, ‘দ্য গ্রেটেস্ট অব অল টাইম’ ছবিতে তাঁর পারিশ্রমিক ছিল ২০০ কোটি রুপি, যা তাকে পারিশ্রমিকের দিক থেকে ভারতের শীর্ষ অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই সাফল্যের মধ্যে তিনি শাহরুখ খান, সালমান খান, প্রভাস, আল্লু অর্জুন, রজনীকান্ত ও আমির খানকেও ছাড়িয়ে যান।
যদিও চলচ্চিত্রে বিজয়ের সাফল্য অভূতপূর্ব, তবু ধীরে ধীরে তার রাজনীতির প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে। সেই কারণে তিনি চলচ্চিত্র জগৎকে বিদায় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। থালাপতি বিজয়ের শেষ সিনেমা হবে ‘জনা নায়াগন’, যা ২০২৬ সালের পোঙ্গল উৎসবের সময় মুক্তি পাবে।
রাজনীতিতে আগমন
বিজয় তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে তামিল চলচ্চিত্রের অন্যতম সফল নায়ক। বাণিজ্যিক সিনেমার পাশাপাশি সামাজিক বার্তা বহনকারী সিনেমার কারণে তরুণ প্রজন্মের কাছে তিনি কেবল নায়কই নন, বরং এক ধরনের রোল মডেল হয়ে উঠেছেন। তার বিপুল ভক্তগোষ্ঠী রয়েছে, যাদের বলা হয় ‘বিজয় ভক্তসেনা’। তারা সিনেমা হলের বাইরেও সামাজিক কার্যক্রমে সক্রিয়। এই ভক্তভিত্তিই বিজয়ের রাজনৈতিক পদক্ষেপকে শক্তিশালী করেছে।
২০২৪ সালের শুরুর দিকে বিজয় ঘোষণা দেন যে, তিনি পূর্ণমাত্রায় রাজনীতিতে প্রবেশ করবেন। গঠন করেন নতুন রাজনৈতিক দল ‘তামিলাগা ভেত্রি কাজাগাম (টিভিকে)’। দলের মূল এজেন্ডা হিসেবে তিনি সামনে এনেছেন দুর্নীতিমুক্ত শাসনব্যবস্থা, শিক্ষার মানোন্নয়ন ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা। বিজয়ের বক্তব্যে প্রায়ই উঠে আসে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তোলার কথা। তার মতে, শিক্ষাই তামিলনাড়ুর উন্নয়নের একমাত্র টেকসই ভিত্তি।
বিজয়ের রাজনৈতিক দর্শন
বিজয়ের বক্তৃতা ও দলীয় ঘোষণাপত্রে এক ধরনের স্পষ্ট বার্তা রয়েছে- তিনি প্রচলিত রাজনীতির বাইরে গিয়ে এক নতুন ধারা তৈরি করতে চান। তার রাজনৈতিক দর্শনে শিক্ষার পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়ন, সামাজিক ন্যায়বিচার, তরুণদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে তিনি কেবল তারকাখ্যাতির ওপর নির্ভর না করে, বিষয়ভিত্তিক রাজনীতিকে সামনে আনতে চাইছেন।
চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
যদিও বিজয়ের জনপ্রিয়তা ব্যাপক, তবে তামিলনাড়ুর রাজনীতি সহজ কোনো মঞ্চ নয়। গভীরভাবে নিহিত দলীয় কাঠামো, গ্রামীণ পর্যায়ের রাজনৈতিক নেটওয়ার্ক ও নির্বাচন পরিচালনার বাস্তবতা তাকে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারে। পাশাপাশি বিরোধী শক্তির সমালোচনা, তারকাখ্যাতি নির্ভর রাজনীতির টেকসইতা নিয়ে প্রশ্নও তুলছে অনেকেই। তবে বিশ্লেষকদের মতে, যদি তিনি তার ভক্তভিত্তিকে রাজনৈতিক শক্তিতে রূপ দিতে পারেন ও বিষয়ভিত্তিক রাজনীতিকে এগিয়ে নিতে সক্ষম হন, তবে আগামী এক দশকে তিনি তামিলনাড়ুর রাজনীতির অন্যতম প্রধান খেলোয়াড় হয়ে উঠতে পারেন।
বর্তমানে তামিলনাড়ুর রাজনীতির দুই প্রধান শক্তি ডিএমকে ও এআইএডিএমকে। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে এই দুটি দলের শাসনে অনেকেই ক্লান্তি ও হতাশা অনুভব করছেন। দুর্নীতি, বেকারত্ব ও সামাজিক বৈষম্যের মতো ইস্যুতে জনমনে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। বিজয়ের আবির্ভাব তাই অনেকের কাছে বিকল্প নেতৃত্বের সম্ভাবনা তৈরি করেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, সিনেমার তারকা পরিচয় তাকে দ্রুত পরিচিতি এনে দিলেও দীর্ঘমেয়াদে তার সক্ষমতা প্রমাণ করতে হবে সাংগঠনিক কাঠামো ও নীতিনির্ভর রাজনীতির মাধ্যমে।