চিকিৎসক সংকটে বন্ধ হয়ে গেল চাঁদপুরের শতবর্ষী দাতব্য চিকিৎসালয়

Bangla Post Desk
ইউএনবি
প্রকাশিত:০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯:৫৯ এএম
চিকিৎসক সংকটে বন্ধ হয়ে গেল চাঁদপুরের শতবর্ষী দাতব্য চিকিৎসালয়

অবশেষে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ‘প্রাথমিক চিকিৎসার বাতিঘর’ খ্যাত চাঁদপুর পৌরসভার শতবর্ষী দাতব্য চিকিৎসালয়। চিকিৎসক সংকটের কারণে এটি আপাতত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে পৌরসভা কর্তৃপক্ষ।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, গত ১ মাস ধরে বন্ধ রাখা রয়েছে মেঘনাপাড়ে অবস্থিত গরীবের চিকিৎসাসেবার এই অন্যতম এই কেন্দ্রটি। এতে করে নদীভাঙন-কবলিত ও চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করা মানুষেরা আরও বিপাকে পড়েছেন। ফলে স্থানীয়দের মাঝে দেখা দিয়েছে চাপা ক্ষোভ। ১০৫ বছর পুরনো এই চিকিৎসাকেন্দ্রটি ফের চালু করার দাবি জানিয়েছেন তারা।

সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, চাঁদপুর জেলার প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা পুরানবাজারের দরিদ্র ও অসহায় মানুষের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে একশ বছরের বেশি সময় আগে প্রতিষ্ঠা করা হয় পৌর দাতব্য চিকিৎসালয়টি।

ব্রিটিশ সরকার, পাকিস্তান সরকার এবং স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শাসনামলে সগৌরবে এই প্রতিষ্ঠানটি নামমাত্র মূল্যে (২ টাকা) মানুষকে চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ সরবরাহ করে আসছিল। সবশেষ চাঁদপুর পৌরসভার অর্থায়নে মাত্র ২ টাকার টিকিটে চিকিৎসা ও ওষুধ দিয়ে ‘মানবতার বাতিঘর’ হিসেবে দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে ব্যাপক সুনাম কুড়ায় প্রতিষ্ঠানটি।

হাবিবুর রহমানসহ (৭৫) স্থানীয় কয়েকজন বর্ষীয়ানের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম দিকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটিতে অস্ত্রোপচারসহ গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা দেওয়া হতো। পরবর্তীতে‌ অর্থ সংকটে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকলেও পৌরসভার ২ জন স্বাস্থ্য সহকারী দিয়ে রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসার কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া হচ্ছিল। এতে হতদরিদ্র মানুষের ছোটখাট অসুখের চিকিৎসার আশ্রয়স্থল হয়ে উঠে দাতব্য চিকিৎসালয়টি। দৈনিক প্রায় ৮০/৯০ জন রোগী এখানে সেবা নিতে আসতেন বলে জানান তারা।

তবে হঠাৎ করেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সংকটের কারণ দেখিয়ে গত মাসে চিকিৎসালয়টি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে দূর-দূরান্ত থেকে আসা হতদরিদ্র মানুষজন পড়েছেন চরম ভোগান্তিতে।

মঙ্গলবার (২ সেপ্টেম্বর) সকালে গিয়ে দেখা যায়, চিকিৎসালয়ের বারান্দায় বসে আছেন বেশ কয়েকজন সেবাপ্রত্যাশী।

তাদের মধ্যে করিমজান ও রহিমা বেগম নামের দুই বৃদ্ধা ইউএনবিকে বলেন, ৫০ বছর ধইরা আমরা এইখানে ডাক্তার দেখাই। কয়দিন ধইরা আইসা আইসা ফিরা যাই। ডাক্তার নাই। সব বন্ধ।‌ আমাগো এই বয়সে আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নাই। এইডা বন্ধ হইলে আমরা কই যামু? আমাগো তো অতো টেহা নাইরে বাপ।

স্থানীয় বাসিন্দা বিএনপি নেতা দুলাল খান বলেন, ‘পৌরসভার অর্থায়নে পরিচালিত এই প্রতিষ্ঠানটি শত বছর ধরে স্থানীয় খেটে খাওয়া মানুষের পাশাপাশি আশপাশের চরাঞ্চলের অসহায়দের চিকিৎসার ভরসাস্থল ছিল। দেশের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টিকারী এই দাতব্য চিকিৎসালয়ে মাত্র দুই টাকার বিনিময়ে অসহায় মানুষরা স্বাস্থ্যসেবা পেয়ে আসছিল। আমরা বারবার দাবি করেছিলাম, এখানে অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ সপ্তাহে অন্তত এক দিন হলেও একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দিয়ে চিকিৎসা দেওয়ার। কিন্তু উন্নয়ন তো দূরের কথা, চিকিৎসক সংকটের দোহাই দিয়ে এখন চিকিৎসালয়টিই বন্ধ করে দিয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা পৌর প্রশাসক ও সিভিল সার্জনের প্রতি আহবান জানাই, যতদ্রুত সম্ভব এখানে চিকিৎসক এনে দাতব্য চিকিৎসালয়টির কার্যক্রম পূনরায় শুরু করা হোক। এ ধরনের পদক্ষেপে সরকারের পাশাপাশি আমাদেরও ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে।’

পুরানবাজারের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও সমাজসেবক নজরুল ইসলাম নজু বেপারী ইউএনবিকে বলেন, ‘পুরানবাজারে অনেকগুলো কলোনি এবং নদী ভাংতি হতদরিদ্র এলাকা রয়েছে। এসব এলাকার দরিদ্র মানুষেরা একশ বছর ধরে এই দাতব্য চিকিৎসালয় থেকে সেবা পেয়ে আসছেন। কিন্তু কী কারণে, কোন উদ্দেশ্যে এটি বন্ধ করা হলো তা আমাদের জানা নেই। দ্রুত এটি চালু করার দাবি জানাচ্ছি।’

চাঁদপুর জেলার প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধা ও নদীভাঙন প্রতিরোধ‌ কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মুজিবুর রহমান ইউএনবিকে বলেন, ‘এখানে দীর্ঘদিন এমবিবিএস ডাক্তার ছিল না। স্বাস্থ্য সহকারীর মাধ্যমে টিকাকেন্দ্রসহ স্বাস্থ্য সেবা বহাল ছিল। গত করোনাকালেও প্রতিষ্ঠানটি ভালো সেবা দিয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করেই জনস্বার্থের বিপরীতে গিয়ে কেন এই প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হলো? এই মানবিক প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করা ঠিক হয়নি বলে আমরা মনে করি। পুরান বাজারের হতদরিদ্র মানুষের চিকিৎসার কেন্দ্র এটি।’ এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক ও পৌর প্রশাসকের সুদৃষ্টি কামনা করেন তিনি।

এ বিষয়ে চাঁদপুর পৌরসভার প্রশাসক মো. গোলাম জাকারিয়া ইউএনবিকে বলেন, ‘দাতব্য চিকিৎসালয়টি পৌর অর্থায়নে পরিচালিত হয়ে আসছিল। মূলত এখানে কোনো চিকিৎসক না থাকায় এটি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘আগে দুজন স্বাস্থ্য সহকারী এটি পরিচালনা করতেন। চিকিৎসক না থাকলে কীভাবে রোগী দেখা হবে? মানুষের স্বাস্থ্যসেবাই-বা কীভাবে নিশ্চিত হবে?’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সিভিল সার্জনের সঙ্গে এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছি। আশা করছি চিকিৎসক পাওয়া গেলে দ্রুত এটি আবার চালু করা হবে। সেই পর্যন্ত সবাই অপেক্ষা করুন, ধৈর্য ধরুন।’