নদীভাঙন-দারিদ্র্য আর অবহেলার মাঝেও স্বপ্ন দেখে যারা


চারদিকে নদী, মাঝে দ্বীপের মতো ছড়িয়ে থাকা কুড়িগ্রামের চরাঞ্চল। এখানকার জীবন যেন জন্ম থেকেই সংগ্রামের আরেক নাম। চরবাসীর জন্য সকাল মানে নতুন দিনের সূচনা নয়, বরং চ্যালেঞ্জের আরেকটি অধ্যায়। আর এখানকার শিশুদের কাছে শৈশব মানে আনন্দ নয়; বরং দায়িত্ব, বেঁচে থাকার লড়াই।
ভোর হলেই ক্ষুধার তাড়নায় কিংবা পরিবারের প্রয়োজনে ছোট ছোট পায়ে শিশু-কিশোররা ছুটে যায় মাঠে- কারও সঙ্গে হাল চাষ করতে, কারও খেতে পানি দিতে, কিংবা কৃষকের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ধান কেটে আনতে। খেলাধুলা বা বিনোদন নয়, এই বয়সেই তারা শিখে ফেলে জীবনের কঠিন অঙ্ক।
চরের শিশুরা যেন জন্ম থেকেই প্রশিক্ষিত একেকটি শ্রমিক। কেমন করে জমিতে মই দিতে হয়, আলু গাছের গোঁড়ায় মাটি তুলে দিতে হয়, কিংবা কীভাবে ধান কাটতে হয়- এসব শিখে নেয় কচি হাতেই। মাটির সঙ্গে এদের হৃদ্যতা এতটাই গভীর যে মাটির গন্ধেই যেন তারা পেয়ে যায় জীবনের মানে।
চর শৌলমারীর কৃষক তাহের আলী বলছিলেন, “সকাল হলেই ছোটরা দৌড়ে চলে যায় ক্ষেতে। অনেকেই বাবার সঙ্গে হাল চাড়ে, কেউ সেচ দেয়, কেউ আবার ধান তোলে।”
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া এখানকার শিশুদের জন্য একমাত্র আনন্দঘন “উৎসব”। কিন্তু মাধ্যমিকে ওঠার সিঁড়ি অতিক্রম করতে পারে খুব অল্প কয়েকজন। যাদের পিঠে স্কুলব্যাগ থাকার কথা, তাদের কাঁধে এসে পড়ে কোদাল কিংবা গরুর দড়ির ভার। সংসারের বোঝা টানতে গিয়ে বইয়ের পাতা পড়ে যায় তাদের চোখের আড়ালে।
কোদালকাটি চর গ্রামের সেলিনা খাতুন বলেন, “আমার ছেলে ক্লাস ফোরে পড়ে, কিন্তু এখন কাজ না করলে আমাদের ভাত জুটবে না।”
স্কুল আর ক্ষেত- এই দুইয়ের ভার বহন করতে না পেরে অনেকেই ঝরে পড়ে। মেয়েরা রান্না, ভাইবোনদের দেখাশোনা কিংবা ঘরে-মাঠে মা-বাবার কাজে সহযোগিতার মধ্যেই হারিয়ে ফেলে নিজেদের শৈশব। তবু বিকেলের আলোয় বালুমাঠে চোখে পড়ে, ১০-১২ জন কিশোর খেলছে ফুটবল কিংবা ক্রিকেট। নেই প্রশিক্ষক, নেই মানসম্মত সরঞ্জাম; তবু তাদের চোখে-মুখে আত্মবিশ্বাস, তেজ। পায়ে ছেঁড়া স্যান্ডেল, গায়ে পুরনো জামা; তবু খেলায় হারিয়ে তারা যেন ভুলে যায় জীবনের দুঃসহ বাস্তবতা।
চর যাত্রাপুরের স্বেচ্ছাসেবক শরিফুল ইসলাম বলেন, “আমাদের চর থেকে কয়েকজন ছেলেপুলে এখন জেলা পর্যায়ে ফুটবল খেলে।”
চরাঞ্চলের শিশুদের জীবন যেন এক মৌন প্রতিবাদ। রাষ্ট্র যখন উপেক্ষা করে, সুযোগ যখন বারবার হাতছাড়া হয়, তখন তারা নিজেদের রক্ত-মাটি-ঘামের শক্তিতেই গড়ে তোলে একেকটি সম্ভাবনার প্রদীপ।
চর শৌলমারীর ১৪ বছরের কিশোর রাজু ইসলাম। সকালে স্কুলে যায়, বিকেলে মাঠে কাজ করে সে। রাজু বলে, “আমরা জানি কীভাবে চাষ করতে হয়, কীভাবে মাঠে কাজ করতে হয়; কিন্তু কীভাবে একটা ভালো স্কুলে ভর্তি হতে হয়, তা জানি না।”
শুধু দারিদ্র্য নয়, এই শিশুরা লড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিশেষ করে ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনের সঙ্গেও। কখন ঘরটা নদীতে তলিয়ে যাবে- এই আশঙ্কা নিয়েই কাটে প্রতিটি রাত। তবু তাদের চোখে দেখা যায় ভালোভাবে বাঁচতে চাওয়ার স্বপ্ন, ঘুরে দাঁড়ানোর এক নিঃশব্দ আকাঙ্ক্ষা।
কুড়িগ্রাম চর উন্নয়ন কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক শফিকুল ইসলাম বেবু বলেন, “চরের শিশুদের নিয়ে কেউ কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনার কথা বলে না। অথচ যদি একটু সুযোগ, একটু সহানুভূতি, আর একটু সমর্থন দেওয়া যায়, তাহলে এই শিশুরাই বদলে দিতে পারে একটি জাতির গল্প। এরা শুধু শ্রম দিতেই জানে না, স্বপ্ন দেখতেও পারে। আর সেই স্বপ্নই একদিন ইতিহাস হয়ে উঠতে পারে, যদি আমরা শুনতে পারি তাদের হৃদয়ের ভাষা।”
তার দাবি, চরবাসীর ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য একটি পৃথক ‘চর বিষয়ক মন্ত্রণালয়’ গঠন জরুরি। এ নিয়ে সরকারের কাছে বহুবার আবেদন করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক নুসরাত সুলতানা বলেন, “চরের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে সরকার কাজ করছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নেও নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।”