আমরা ন্যায়বিচারের অপেক্ষায় ছিলাম: জামায়াত আমির


জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, দীর্ঘদিন আমরা এমন একটি সুবিচারপূর্ণ রায়ের জন্য অপেক্ষা করেছিলাম। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক মামলার বিচার পরিচালনার সময় আন্তর্জাতিক আইন ও দেশের অভ্যন্তরীণ আইনের কোনোটি অনুসরণ না করে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে আনা সকল অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দিয়ে রায় দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
জামায়াত আমির আরও বলেন, ‘সেসময় সংবিধান কোনো বিষয় ছিল না, আইন কোনো বিষয় ছিল না। যাদের ইশারায় কোর্ট পরিচালনা করা হতো, তাদের ইচ্ছাই ছিল আইন; সেটা বৈধ হোক কিংবা অবৈধ হোক।’
মঙ্গলবার (২৭ মে) বেলা সাড়ে ১১টায় রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটের মুক্তিযোদ্ধা হলে এক সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতের আমির এসব কথা বলেন।
জামায়াতের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলাম আপিল বিভাগের রায়ে খালাস পাওয়ার পর প্রতিক্রিয়া জানাতে দলটি এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘গোটা বিচার প্রক্রিয়ার সময় দুটি টর্চার সেল গঠন করা হয়েছিল। একটার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘সেইফ হোম’, আরেকটার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘সেইফ হাউজ’। সেইফ হোমে ভিকটিম নেতাদেরকে নিয়ে নির্যাতন করে নাজেহাল করা হতো। সেখানে উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় সেইফ হোমে রেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন তাদের উপর অত্যাচার চালানো হয়েছে।’ অন্যদিকে সেইফ হাউজে এনে রাখা হতো যাদের সাক্ষী করা হতো। এসব মিডিয়ায় উঠে এসেছে।
তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন সংগঠন এই বিচার প্রক্রিয়ার নিন্দা জানিয়েছে। তাদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তারা তা আমলে নেয়নি। কারণ, তারা জানতো স্বচ্ছ বিচার হলে খুন করা যাবে না।’
জামায়াত আমির বলেন, ‘আমরা গণঅভ্যুত্থানের পর আমাদের শহীদ, আহত ও পঙ্গু ভাই বোনদের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। অনেক সীমাবদ্ধতার কারণে আমরা পুরো কর্তব্য আদায় করতে পারিনি। আপনারা আমাদের ক্ষমা করবেন আমাদের কোনো আচরণে এবং কোনো কথা ও কাজের মাধ্যমে কষ্ট পেয়ে থাকলে যখন যেভাবে হোক। কেউই ভুলের ঊর্ধ্বে নয়, দল হিসেবেও আমরা দাবি করি না আমরা ভুলের ঊর্ধ্বে। এ সংগঠনের কোনো নেতাকর্মী বা সহকর্মীদের দ্বারা যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, কষ্ট পেয়েছেন, সবার কাছে বিনা শর্তে ক্ষমা চাই। আপনারা আমাদেরকে ক্ষমা করে দিবেন।’
জামায়াতপ্রধান বলেন, ‘জামায়াত বিগত শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনামলে ভয়ংকর জুলুমের শিকার হয়েছিল। আমাদের ১১ জন শীর্ষ নেতাকে মিথ্যা, সাজানো, ও পাতানো মামলায় এবং মিথ্যা সাক্ষীর মাধ্যমে কার্যত জুডিসিয়াল কিলিং করা হয়েছে।’
জামায়াত আমির বলেন, স্বৈরশাসনের আমলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ধর্মীয় ও সামাজিক সংগঠন, বিডিআর সদস্যরা এবং সাধারণ প্রতিবাদী জনগণ যাদেরকে নির্মমভাবে খুন করা হয়েছে। চব্বিশের বিপ্লবের সময় যাদের হত্যা করা হয়েছে তাদের শহীদ হিসেবে কবুলের জন্য দোয়া করেন তিনি।
তিনি বলেন, আজ বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ আমাদের রিভিউ আবেদন শুনানির পর এটিএম আজহারুল ইসলামকে তার বিরুদ্ধে আনা সকল অভিযোগ থেকে খালাস দিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, জাতির এই সংকটময় মুহূর্তে আমাদের নেতারা বেঁচে থাকলে তাদের প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা-অভিজ্ঞতা দিয়ে এই জাতিকে পথ দেখাতে পারতেন। ক্যাঙ্গারু কোর্ট তাদের হত্যা করেছে।
তিনি বলেন, এই মামলাগুলো পরিচালনা করতে গিয়ে সীমাহীন জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। সাবেক বিচারপতি এসকে সিনহা স্বীকার করেছেন কিভাবে পরিকল্পনা মাফিক, ঠান্ডা মাথায় এই নেতাদের খুন করতে হবে—তার ছক তৎকালীন বিচার বিভাগ ও সরকার মিলে তৈরি করেছিলেন। স্কাইপ কেলেঙ্কারির ঘটনা গোটা বিশ্ববাসীর নিকট নিন্দিত হয়েছে, তিরষ্কৃত হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন।
তিনি আরও বলেন, আমাদের নেতারা তাদের সবটুকু যোগ্যতা উজার করে দিয়ে তারা বাংলাদেশে সুস্থ ধারার রাজনীতি করতে চেয়েছিলেন। দলের দুজন শীর্ষ নেতা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সততা এবং দক্ষতার সঙ্গে পালন করেছেন বলে জানান তিনি।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, পরিবারের মানুষকে খুনের অভিযোগে নেতাদের ট্রায়াল চলছে সেই পরিবারের কারো সাক্ষ্য নেওয়া হয়নি। সাক্ষ্য দিতে আসলে সাদা পোশাকের পুলিশ সুখরঞ্জনবালিকে অপহরণ ও নির্যাতন করে ভারতের মাটিতে ফেলে রেখেছিল। জেল খেটে দীর্ঘদিন পর তিনি দেশে ফিরেছেন।
জামায়াত আমির বলেন, আদালত আমাদের নেতাদের উপর জুলুম করে, জোর করে যা নয়- তা স্বীকার করানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এমনকি রায় বাস্তবায়নের আগেও ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। তারা ফাঁসির কাষ্ঠে দাঁড়িয়েছেন, কিন্তু অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেন নাই।
তিনি বলেন, ব্রিটেনের আদালত এই বিচারকে বলেছিল জেনোসাইড টু দ্যা জাস্টিস। আজকে আমাদের আপিল বিভাগ বলেছে মিসক্যারেজ অব দ্যা জাস্টিস। ন্যায়ভ্রষ্ট রায়, অন্যায় রায়।
এর আগে সাজা দেওয়া হয়েছিল দলটির সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযম, সাবেক নায়েবে আমির শায়খ আবুল কালাম মোহাম্মদ ইউসুফ, সাবেক আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামান ও আব্দুল কাদের মোল্লা, সাবেক নায়েবে আমির আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, সাবেক কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলী, সাবেক নায়েবে আমির সাবেক এমপি মাওলানা আব্দুস সোবহান, সাবেক কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য আব্দুল খালেক মন্ডল।
জামায়াত আমির বলেন, আমরা প্রতিশোধ নেইনি, আমরা ন্যায়বিচার চাই। এ রায়ের মধ্য দিয়ে পরিষ্কার হয়ে গেছে যে এই রায় ছিল ইচ্ছাকৃত; গণহত্যার মাধ্যমে নেতৃত্ব শূন্য করা। একটা দেশ ও দলের নেতৃত্ব শূন্য করার মানেই হচ্ছে জনগণকে অন্ধকারের মাঝে ঠেলে দেওয়া। সত্যকে চেপে রাখা যায় না। সত্য মেঘের আড়াল ভেদ করে আলোর ঝলক নিয়ে আসে— সে সত্যটাই আজ প্রমাণিত হলো।
সংবাদ সম্মেলনে ছিলেন দলটির নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের, ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মা’ছুম, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, ড. হামিদুর রহমান আযাদ, মাওলানা আবদুল হালিম, মাওলানা মোয়ায্যম হোসাইন হেলাল, অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান, নুরুল ইসলাম বুলবুল, সেলিম উদ্দিন, এটিএম আজহারুল ইসলামের ছেলে তাসনিম আজহার সুমন প্রমুখ।