প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে যা বললেন ৭ দলের নেতারা


দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করতে সাতটি রাজনৈতিক দল ও হেফাজতে ইসলামের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আজ মঙ্গলবার (২ সেপ্টেম্বর) বিকেল ৫টার পরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় এ বৈঠক হয়।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে বের হয়ে কথা বলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।
ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন বলেন, ‘আজকের বৈঠক ছিল দেশ ও জাতির ক্রান্তিলগ্নে। আমরা উপদেষ্টামণ্ডলীকে ধন্যবাদ জানিয়েছি। স্বাধীনতার পর থেকে যারাই ক্ষমতায় ছিল, তারা জনপ্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। যে লাউ সেই কদু করে নির্বাচন দিলে এবারও জাতির প্রত্যাশা পূরণ হবে না। ঐকমত্য কমিশনে ২৬টি দল পিআরের পক্ষে মত দিয়েছে। দেশের দুর্নীতি সন্ত্রাস, ভোট ডাকাতি, এককভাবে নির্বাচন, ডামি প্রার্থী এগুলো মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন পি আর পদ্ধতিতে নির্বাচন। পি আর পদ্ধতি নির্বাচন না দিলে গণভোটের ব্যবস্থা করেন। জিয়াউর রহমান, এরশাদ সাহেবকে চায় কি চায় না এর জন্য গণভোট হয়েছে। তারা বলেছেন, এসব বিষয়ে চিন্তাভাবনা উনারা করবেন।’
আশরাফ আলী আকন আরও বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। এখনই সন্ত্রাস বন্ধ করতে পারে না যখন ৩০০ আসনে নির্বাচন হবে তখন সন্ত্রাস, জালভোট কীভাবে বন্ধ করবে? লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই।
আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, ১৪ দলের সকল দলের রাজনীতি নিষিদ্ধ চেয়ে তিনি আরও বলেন, পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের আগে সংস্কার চাই, বিচার চাই। সংস্কার, বিচার ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। সঠিক নির্বাচন যাতে না হয় এ জন্য একটা শক্তি ষড়যন্ত্র করছে এ জন্য তিনি আমাদের ডেকেছেন।
এলডিপির সেক্রেটারি জেনারেল রেদোয়ান আহমেদ বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য কি কি পদক্ষেপ নিতে পারি এসব জানতে চেয়েছেন। আমরা বলেছি, আমাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থা উন্নতিকল্পে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। বিগত সরকার তাদের লোক এমনভাবে বসিয়েছে যে প্রশাসনের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত আছে। একটা নিরপেক্ষ করার জন্য সরকারের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।’
রেদোয়ান আহমেদ বলেন, ‘লটারি করে ট্রান্সফার বিষয়টি শিশুসুলভ। দেশের কোথায় কেমন অবস্থা তার ওপর নির্ভর করে দক্ষতার সঙ্গে বিবেচনা করে বদলি করতে হবে। অস্ত্র যেসব লুণ্ঠন হয়েছিল সেগুলো এখনো পুরোপুরি উদ্ধার করা যায়নি। এই অস্ত্রগুলো উদ্ধার করা না গেলে মানুষের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক থাকবে না।’
পিআর পদ্ধতি নির্বাচনের প্রসঙ্গে এই নেতা বলেন, ‘আমরা নির্বাচনের একটা পক্ষশক্তি হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা একটা নির্বাচন করবেন বলে জাতিকে আশ্বস্ত করেছেন। যুগে যুগে কালে কালে নির্বাচনের মাধ্যমেই জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পারে। পিআর পদ্ধতি ইংল্যান্ড আমেরিকা ভারতে নাই। আজকে যারা পি আর পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করছেন তারা ঐকমত্য কমিশনের শুরুতে এই আলোচনা করেননি। এখন সরকার যখন একটা শিডিউল ঘোষণা করেছেন তখন তারা এই কথা বলছেন। আমরা পিআর নয়, আসনভিত্তিক নির্বাচনের পক্ষে।’
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব আজিজুর রহমান ইসলামাবাদী বলেন, ‘আমরা দাবি জানিয়েছি, সংবিধানে আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস পুনর্বহাল করতে। জুলাই সনদে শাপলা চত্বরে যে গণহত্যা হয়েছে তা অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়েছি। আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকারের চিহ্নিত ক্রিমিনাল, দোসর তাদের গ্রেপ্তার করুন। প্রশাসনের মধ্যে যারা আছে তাদের বহিষ্কার করুন।’
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বদ্ধপরিকর। একটা উৎসবমুখর নির্বাচন তারা আয়োজন করতে চান। তাই তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পরামর্শ সহযোগিতা চেয়েছেন। আমরা দুটি বিষয় বলেছি। একটা হচ্ছে, সরকার যেভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে, রাষ্ট্র পুনর্গঠন যথার্থ হয়নি। সে কারণে নানান সংকট তৈরি হচ্ছে। এতে রাজনৈতিক মহলে একটা অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে। নির্বাচনের পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।’
জোনায়েদ সাকি বলেন, দ্বিতীয়ত, ঐকমত্য কমিশনে যে রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিনিধিত্ব করেছে তাদের নিয়ে এবং নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন প্রয়োজন। এতে যেখানে যে ঘটনাগুলো ঘটনা সেই কমিটির সকলে মিলে ঠিক করবে। এখন থেকেই এটা কাজ শুরু করা দরকার। বিচারকে আরও দৃশ্যমান করা যেমন জরুরি তেমনি সংস্কার কীভাবে হবে সেগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধের জায়গা দেখা যাচ্ছে। আমরা বলেছি, যে সকল বিষয় সংবিধান সংশ্লিষ্ট নয় সেগুলো অরডিন্যান্স এর মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে পারে।
বিচার, সংস্কার, নির্বাচন এখন বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ মন্তব্য করে সাকি আরও বলেন, সংবিধান একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভিত্তি। সংবিধানে প্রতিনিধিত্ব মূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। একটা সংসদ গঠন ছাড়া কোন ভাবেই সংস্কার সম্পন্ন করতে পারব না।
এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘আমরা বলেছি সরকারের কার্যক্রমে শৃঙ্খলার অভাব দেখতে পাচ্ছি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় দেখা গেছে, সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়হীনতা আছে। এটা ঠিক না হলে নির্বাচন নিয়ে সংশয় কাটবে না। এসব ঘটনায় সরকারের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।’
মঞ্জু আরও বলেন, জাতীয় ও জেলা উপজেলা পর্যায়ে একটা সমন্বিত কমিটি করার কথা বলেছি যাতে আসনভিত্তিক সংকট সমাধানে তারা ভূমিকা রাখতে পারে। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, তাদের পুরো টিমে নিরপেক্ষ নির্বাচনের অভিজ্ঞতার একজনও নেই। আমরা বলেছি, যাতের পূর্বে নিরপেক্ষ নির্বাচনের অভিজ্ঞতা আছে তাদের চুক্তিভিত্তিক হলেও নিয়োগ দেওয়ার কথা বলেছি। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, নির্বাচন যে চ্যালেঞ্জ এটা সবাই মিলে ফেইস করা ছাড়া কোনো উপায় নাই।
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, ‘নুরুল হক নুরের ওপর হামলার ঘটনায় সরকারের পক্ষ থেকে আজ দুঃখপ্রকাশ করেছেন। সরকারের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটির কথা বলা হয়েছিল, আইন উপদেষ্টা জানিয়েছেন, বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি আজ রাতেই প্রকাশ করা হবে। আজ সকালে আমি ঢাকা মেডিকেলে গিয়েছিলাম, নূর কথা বলতে পারছেন না। কথা বললে গলা দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। আমাকে নুর বলেছেন, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। নুরুল হক নুরকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়া হবে এটার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।’
রাশেদ খান আরও বলেন, যারা এখন প্রশাসন ও বিভিন্ন বাহিনীর প্রধান তারা কি আপনার সরকারে আনুগত্য প্রকাশ করছে? সহযোগিতা করছে? আমরা দেখছি করছে না। তাই আমরা বলেছি, এখানে দুটি সরকার কাজ করছে, একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, আরেকটা অদৃশ্য সরকার। গণভোটের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেছিলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গণভোটের সুযোগ নেই। এখন যেহেতু রাজনৈতিক মহলে গণভোটের দাবি উঠেছে সে ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা কি হবে?
নির্বাচনের বিষয়ে এই নেতা বলেন, ‘নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে? সরকারের পক্ষ থেকে এটা স্পষ্ট করা হলে ধোঁয়াশা কেটে যায়। প্রত্যেকটা দল যাতে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে সে জন্য আস্থা তৈরি করা দরকার।’
নুরের স্ত্রী মারিয়া আক্তার বলেন, ‘আমাকে মাননীয় উপদেষ্টা আমাকে ডেকেছিলেন নুরের খোঁজখবর নেওয়ার জন্য। উনি খবর নিয়েছেন এবং যে ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে তার বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। তার শারীরিক অবস্থার বিবেচনা করে তাকে বাইরে উন্নত চিকিৎসার কথা বলেছেন। গতকাল দুপুর পর্যন্ত ছিল কিন্তু বিকেল থেকে আবারও নাক থেকে ব্লিডিং হচ্ছে। কথা বলতে গেলে হঠাৎ চুপ হয়ে যাচ্ছে না। এখনো শারীরিক অবস্থা ভালো না।’
বৈঠকে অংশ নেওয়া দলগুলো সাতটি দল হলো—এবি পার্টি, নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ, এলডিপি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জাতীয় গণফ্রন্ট। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এই ধারাবাহিক সংলাপকে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হিসেবে দেখা হচ্ছে।