গাজায় ‘মানবিক শহর’ নির্মাণকে কেন্দ্র করে ইসরায়েলে অভ্যন্তরীণ বিরোধ চরমে


দক্ষিণ গাজায় প্রস্তাবিত ‘মানবিক শহর’ নির্মাণের খরচ ও প্রভাব নিয়ে ইসরায়েলি সরকার ও সামরিক বাহিনীর মধ্যে বিরোধ চরমে উঠেছে।
এরই মধ্যে ওই শিবির নির্মাণ করা হলে ফিলিস্তিনিদের জন্য সেটি মূলত একটি ‘বন্দিশিবির’ (কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প) হবে বলে মন্তব্য করেছেন ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইহুদ ওলমার্ট। তার এই বক্তব্য তেল আবিবের রাজনীতিতে তীব্র সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। সব মিলিয়ে মানবিক শহর ঘিরে ইসরায়েলের অভ্যন্তরেই চলছে তোলপাড়।
সম্প্রতি সেনাবাহিনীকে দক্ষিণ গাজার ধ্বংসস্তূপে এই মানবিক শহর নির্মাণের জন্য পরিকল্পনা তৈরির নির্দেশ দেন ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ। এই প্রকল্পটি হামাসের সঙ্গে চলমান যুদ্ধবিরতির আলোচনায় অন্যতম জটিল ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।
গাজার দক্ষিণের রাফাহ শহরের ধ্বংসস্তূপে সেনা অবস্থান বজায় রাখার শর্ত দিয়েছে ইসরায়েল। সেখানেই এই শিবির নির্মাণের পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেকোনো যুদ্ধবিরতির চুক্তি বাস্তবায়নের আগে হামাস চাইছে গাজা থেকে সম্পূর্ণ সেনা প্রত্যাহার। নিউ ইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক বার্তায় সংগঠনটির সিনিয়র সদস্য হুসাম বাদরান বলেন, ‘শিবির নির্মাণ পরিকল্পনা ইচ্ছাকৃতভাবে জটিলতা সৃষ্টিকারী একটি দাবি, এটি আলোচনা জটিল করে তুলছে।’
বাদরান বলেন, তাদের পরিকল্পিত ওই শিবিরটি হবে একটি বিচ্ছিন্ন শহর যা একটি গেটোর মতো দেখতে হবে। এটি সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য এবং কোনো ফিলিস্তিনিই এতে সম্মত হবেন না।
গেটো মানে হলো একটি অবরুদ্ধ এলাকা, যেখানে একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে আলাদা করে রাখা হয়। এটি সাধারণত বিচ্ছিন্ন, মানবিক সেবাবঞ্চিত ও অবহেলিত পরিবেশ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।
গত সপ্তাহে সেনাবাহিনীকে দক্ষিণ গাজার ধ্বংসস্তূপে এই মানবিক শহর নির্মাণের জন্য পরিকল্পনা তৈরির নির্দেশ দেন কাৎজ। এই শিবিরটি গাজা ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে বিস্তৃত ইসরায়েলি সামরিক ‘মোরাগ করিডর’ ও মিসরীয় সীমান্তের মাঝে নির্মিত হবে।
কাৎজ জানান, প্রাথমিকভাবে ৬ লাখ মানুষকে সেখানে স্থানান্তর করা হবে এবং পরে গাজার পুরো জনসংখ্যাকে সেখানে স্থানান্তরের পরিকল্পনা রয়েছে। এই শিবিরে একবার ঢোকানো হলে ফিলিস্তিনিরা কেবল অন্য দেশে যাওয়ার জন্যই বের হতে পারবেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।
মানবিক শহরের এই পরিকল্পনাকে সমর্থন করেছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তবে এটি নিয়ে ইসরায়েলের মিত্রদের মধ্যে, বিশেষ করে যুক্তরাজ্যে, এমনকি ইসরায়েলের অভ্যন্তরেও তীব্র উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
২০০৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী হিসেব দায়িত্ব পালন করা ওলমার্ট এই পরিকল্পনার সবচেয়ে প্রভাবশালী অভ্যন্তরীণ সমালোচক হিসেবে সামনে এসেছেন।
তিনি বলেন, ফিলিস্তিনিদের জোর করে শিবিরে পাঠানো হলে তা ‘জাতিগত নির্মূলের’ সামিল হবে। তাছাড়া, ইসরায়েলি পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে প্রস্তাব দিয়েছেন, ফিলিস্তিনিদের জন্য সেটি মূলত একটি ‘বন্দিশিবির’ (কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প) হবে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
এই বক্তব্যের মাঝে ইসারয়েলের এই পরিকল্পিত শিবিরকে নাৎসি জার্মানির সময়কার বন্দিশিবিরের সঙ্গে তুলনা করেন তিনি। এতে করে তীব্র আক্রমণের শিকারও তিনি হয়েছেন।
ইসরায়েলের ঐতিহ্য বিষয়ক মন্ত্রী আমিখাই এলিয়াহু ওলমার্টকে কারাবন্দি করার আহ্বান জানিয়েছেন। সেই সঙ্গে তিনি পরোক্ষভাবে তার আগের দুর্নীতির মামলার কারাদণ্ডের কথাও স্মরণ করিয়ে দেন।
এলিয়াহু বলেন, ‘ওলমার্ট ইতোমধ্যে কারাগার খুব ভালো করেই চেনেন। তিনি যেভাবে সারা বিশ্বে ঘৃণা ও ইহুদিবিদ্বেষ ছড়িয়ে বেড়াচ্ছেন, তাকে থামানোর আর কোনো উপায় নেই।’
এদিকে, প্রতিরক্ষামন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করলেও এই শিবির নির্মাণের প্রস্তাবের বিরোধিতা করছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী।
রবিবার (১৩ জুলাই) রাতে নিরাপত্তা মন্ত্রিসভার বৈঠকে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) চিফ অব স্টাফ এয়াল জামিরের সঙ্গে নেতানিয়াহু বিরোধে জড়িয়ে পড়লে বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমের খবরেই এসব প্রকাশ পায়।
এই প্রকল্পে বিপুল অর্থ ও সম্পদ ব্যয় হবে বলে অভিযোগ করেন জামির। এটি সেনাবাহিনীর সামরিক সক্ষমতা হ্রাস করবে এবং জিম্মিদের উদ্ধার প্রচেষ্টাকে দুর্বল করবে বলেও সতর্ক করেন তিনি।
ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, বেসামরিক নাগরিকদের স্থানান্তর ও গাদাগাদি করে রাখা যুদ্ধের লক্ষ্য নয় বলে এক আইনি আবেদনের জবাবে জানিয়েছিল জামিরের কার্যালয়।
ইসরায়েলের চ্যানেল ১২ জানিয়েছে, জামিরের প্রকল্প পরিকল্পনাকে অতিরিক্ত ব্যয়বহুল ও ধীরগতির বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন নেতানিয়াহু।
তিনি বলেন, ‘আমি বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা চেয়েছিলাম।’ এ ছাড়া, মঙ্গলবারের (১৫ জুলাই) মধ্যে আরও সস্তা ও দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য পরিকল্পনা চেয়ে নির্দেশ দেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী। তবে ইসরায়েলের অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও এই মানবিক শহর পরিকল্পনা নিয়ে আর্থিক আপত্তি জানিয়েছেন।
দৈনিক ইয়েদিওথ আহরোনোথ জানায়, অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মতে, এ প্রকল্পের বার্ষিক ব্যয় হবে আনুমানিক ১৫ বিলিয়ন শেকেল (প্রায় ৩৩০ কোটি পাউন্ড)। এটি ইসরায়েলের বাজেটের ওপর বিরাট চাপ ফেলবে বলে আশঙ্কা করেন তারা।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই ব্যয়ের বেশিরভাগই ইসরায়েলি জনগণের করের অর্থ থেকেই বহন করতে হবে। এতে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও কল্যাণ খাতে বরাদ্দ কমে যেতে পারে।
ইসরায়েলের আরেক পত্রিকা ওয়াই-নেট জানিয়েছে, জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীরা বলছেন, এই মানবিক শহর নির্মাণে ব্যয় হবে আনুমানিক ২৭০ থেকে ৪০০ কোটি ডলার। শুরুতে এর পুরো খরচই ইসরায়েলকে বহন করতে হবে।
সব মিলিয়ে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর ‘মানবিক শহর’ পরিকল্পনাটিই এখন পড়ে গেছে অনিশ্চয়তায়।