ট্রাম্পের ‘নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের’ আহ্বানের পর ইরানে তীব্র হামলা ইসরায়েলের


তেহরানকে লক্ষ্য করে আবারও বড় পরিসরে বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইরানকে ‘নিঃশর্তে আত্মসমর্পণের’ দাবি জানানোর পরই এ হামলা চালানো হয়। এই হামলার প্রতিশোধ নেওয়ার হুমকি দিয়েছে ইরান।
স্থানীয় সময় বুধবার (১৮ জুন) ভোরে তেহরানে তীব্র হামলা চালায় ইসরায়েল। ভোর ৫টার দিকে তেহরানের পূর্বাঞ্চলীয় হাকিমিয়েহ এলাকার প্যারামিলিটারি রেভল্যুশনারি গার্ডের একটি অ্যাকাডেমিতে হামলার কথা জানিয়েছে তেল আবিব।
হামলায় প্যারামিলিটারি রেভল্যুশনারি গার্ডের খাতাম আল-আম্বিয়া কেন্দ্রীয় সদর দপ্তরের প্রধান জেনারেল আলী শাদমানিকে হত্যারে দাবি করেছে ইসরায়েল। জেনারেল আলী শাদমানিকে ইরানের সর্বোচ্চ জীবিত সামরিক কমান্ডার হিসেবে আখ্যায়িত করেছে তেল আবিব।
হামলার আগেই অবশ্য মেহরাবাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দক্ষিণের একটি এলাকা লক্ষ্য করে হামলা চালাতে পারে বলে জানিয়েছিল ইসরায়েল। ওই এলাকায় আবাসিক ও সামরিক স্থাপনাসহ ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানি ও শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
এদিকে, এ হামলা নিয়ে তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি ইরান সরকার।
ট্রাম্পের বিভ্রান্তিকর বক্তব্য ও ইরানের আত্মসমর্পণের দাবি
যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধবিমান পাঠানোর পরই সংঘাত নিয়ে একাধিক মন্তব্য করেন ট্রাম্প। একদিকে তিনি বলেন, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি কোথায় লুকিয়ে আছেন তা যুক্তরাষ্ট্র জানে। আবার তিনিই বলেন ‘অন্তত এই মুহূর্তে’ তাকে হত্যার পরিকল্পনা নেই।
ট্রাম্পের এমন বক্তব্য চলমান সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে।
এদিকে, ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যকার সংঘাতের কারণে এক দিন আগেই কানাডায় অনুষ্ঠিত জি-৭ সম্মেলন ত্যাগ করে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরেছেন ট্রাম্প।
সে সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি যুদ্ধবিরতির দিকে তাকিয়ে নেই। আমরা যুদ্ধবিরতির চেয়েও ভালো কিছুর দিকে চেয়ে আছি।’
ঠিক কীসের দিকে চেয়ে আছেন—তা স্পষ্ট করতে তিনি জানান, ইরানের সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে এই সংঘাতের একটি প্রকৃত সমাপ্তি দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। তাছাড়া তিনি খুব একটা আলোচনার মেজাজে নেই বলেও জানান সাংবাদিকদের।
অবশ্য কূটনৈতিক আলোচনা এখনও একটি বিকল্প হিসেবে বিবেচনায় আছে বলেও আবার মন্তব্য করেন ট্রাম্প। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ও মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফকে ইরানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পাঠাতে পারেন বলেও জানান তিনি।
এর আগে, ইরানের হামলা প্রতিরোধ ও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্য করে ইরানের হুমকির জবাব দিতে মধ্যপ্রাচ্য ও এর আশপাশে যুদ্ধবিমান ও যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করে যুক্তরাষ্ট্র।
বুধবার অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) বিশ্লেষণ করা স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যায়, বাহরাইনে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর পঞ্চম নৌবহরের সদর দপ্তরের আশপাশে কোনো জাহাজ নোঙর করে রাখা নেই। ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে নিরাপত্তার স্বার্থে জাহাজ ছড়িয়ে দেওয়া একটি প্রচলিত নৌ-কৌশল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হোয়াইট হাউসের এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে খবরে জানানো হয়, ট্রাম্প ও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু মঙ্গলবার ফোনে বর্তমান যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনাও করেছেন।
এর আগে, সোমবার (১৬ জুন) নিজের ট্রুথ সোশ্যালে ইরান-ইসরায়েল সংঘাত পঞ্চম দিনে গড়ানোর আগেই তেহরানবাসীদের শহর খালি করার আহ্বান জানান ট্রাম্প। তিনি বলেন, সবাইকে এখনই তেহরান ত্যাগ করতে হবে।
তেহরান খালি করার কথা কেন বলেছেন জানতে চাইলে ট্রাম্প বলেন, ‘আমি শুধু চাই, মানুষ নিরাপদ থাকুক।’
প্রতিশোধের হুমকি ইরানের
তেহরান খালি করা নিয়ে ট্রাম্পের পোস্টের বিষয়ে ইরান তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে দেশটির সামরিক নেতারা জানিয়েছেন, শিগগিরই আরও হামলার মুখোমুখি হবে ইসরায়েল।
ইরানের সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আবদুল রহিম মৌসাভি এক ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘এখন পর্যন্ত পরিচালিত অভিযানগুলো শুধুই সতর্কতা ও প্রতিরোধমূলক ছিল। তবে খুব শিগগিরই ইসরায়েলকে শাস্তি দিতে হামলা চালানো হবে।’
এদিকে, ইসরায়েলে নতুন করে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের পর সেখানের জনগণকে আশ্রয়কেন্দ্রের কাছাকাছি থাকার আহ্বান জানায় ইরান।
যদিও তেহরানের বেশিরভাগ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করা হয়েছে এবং জরুরি পরিষেবা সংস্থাগুলোর কাছে তাৎক্ষণিক কোনো হতাহতের খবর নেই বলে জানিয়েছে তেল আবিব।
তবে ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে, বিশেষ করে মরুভূমির শহর ডিমোনায় সতর্কতামূলক সাইরেন বাজতে শোনা গেছে। ওই এলাকাটি ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচির কেন্দ্রস্থল হিসেবে পরিচিত। অবশ্য তেল আবিব কখনো এই স্বীকৃতি দেয়নি।
অন্যদিকে, পাল্টাপাল্টি হামলার মধ্যে জেরুজালেমে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস শুক্রবার (২০ জুন) পর্যন্ত বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
বাইরের বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করছে ইরান
এপির খবরে বলা হয়েছে, ইরানি জনগণকে বাইরের বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ সীমিত করতে দেশটির কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করছে বলে মনে হচ্ছে। হামলার মধ্যে ফোন ও ইন্টারনেট পরিষেবা ব্যাহত হয়েছে, ল্যান্ডলাইন ফোনে আন্তর্জাতিক কল করা বা গ্রহণ করা যাচ্ছে না।
ইন্টারনেট পর্যবেক্ষক সংস্থা নেটব্লকস (NetBlocks) জানিয়েছে, তারা দেশটি থেকে ইন্টারনেট ট্রাফিকের উল্লেখযোগ্য হ্রাস শনাক্ত করেছে।
ইরানের সাইবার নিরাপত্তা কমান্ড রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে এক বিবৃতিতে ইন্টারনেট সীমিত করার বিষয়টি স্বীকার করে জানায়, এই পদক্ষেপ শত্রুদের ‘সাইবার ও সামরিক অভিযান চালাতে অবকাঠামো ব্যবহারের পথ বন্ধ’ করার উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছে।
অতীতেও জাতীয় পর্যায়ের আন্দোলন ও ১৯৮০-র দশকের ইরান-ইরাক যুদ্ধ চলাকালে গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ ব্যবস্থায় সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছিল ইরান।
বর্তমানেও আন্তর্জাতিক ওয়েবসাইটগুলো বন্ধ বলে মনে হচ্ছে, তবে স্থানীয় ওয়েবসাইটগুলো চালু আছে। এ থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, ইরান তার ‘হালাল নেট’ চালু করেছে। এটি স্থানীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত ইন্টারনেট ব্যবস্থা, যা জনসাধারণের দেখার পরিধি সীমিত করার উদ্দেশ্যে তৈরি।
মঙ্গলবার ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে জনগণকে তাদের মোবাইল ফোন থেকে হোয়াটসঅ্যাপ মুছে ফেলার আহ্বান জানানো হয়েছে। তেহরানের অভিযোগ, এই অ্যাপ ইসরায়েলে তথ্য পাঠানোর জন্য ব্যবহারকারীর তথ্য সংগ্রহ করছে। তবে নিজেদের অভিযোগের সপক্ষে কোনো প্রমাণ উপস্থান করেনি কর্তৃপক্ষ।
এই অভিযোগের পর এক বিবৃতিতে হোয়াটসঅ্যাপ জানায়, যে সময়ে মানুষের এই ধরনের সেবা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, ঠিক সেই সময়ে এ ধরনের ভুয়া প্রতিবেদনের তথ্যকে অজুহাত হিসেবে দেখিয়ে আমাদের সেবা বন্ধ করার চেষ্টা হচ্ছে।
পারমাণবিক স্থাপনায় আরও ক্ষয়ক্ষতির কথা জানাল আন্তর্জাতিক সংস্থা
আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) জানিয়েছে, তারা বিশ্বাস করে যে ইসরায়েলের প্রথম দফার বিমান হামলায় ইরানের নাতাঞ্জ পরমাণু সমৃদ্ধকরণ স্থাপনার ভূগর্ভস্থ কেন্দ্রটিতে সরাসরি প্রভাব পড়েছে।
শুক্রবারের হামলার পর সংগ্রহ করা স্যাটেলাইট চিত্রে ‘ভূগর্ভস্থ পরমাণু সমৃদ্ধকরণ কক্ষে সরাসরি আঘাতের ইঙ্গিতকারী অতিরিক্ত উপাদান’ দেখা গেছে বলে জানায় সংস্থাটি।
আইএইএ এর আগে জানিয়েছিল, ইসরায়েলি হামলায় নাতাঞ্জের একটি ভূপৃষ্ঠস্থ পরমাণু সমৃদ্ধকরণ ভবন ধ্বংস হয়েছে এবং সেই স্থাপনার জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহকারী যন্ত্রপাতিও অকেজো হয়েছে। এই স্থাপনাটি তেহরান থেকে প্রায় ২২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত।
ইরান তাদের অধিকাংশ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কাজ ভূগর্ভে করে থাকে যাতে বিমান হামলা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
ইসরায়েল বহুবার নাতাঞ্জে হামলা চালিয়েছে এবং দাবি করেছে যে তারা এর ভূগর্ভস্থ কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, যা বিশেষজ্ঞদের মতে ১০ হাজার সেন্ট্রিফিউজ ধারণক্ষমতাসম্পন্ন। এগুলো ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে পারে।
ইরান দাবি করে যে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশও মূল্যায়ন করেছে যে, ২০০৩ সালের পর থেকে তেহরানের পরমাণু অস্ত্র তৈরির কোনো সংগঠিত প্রচেষ্টা নেই।
তবে আইএইএ বারবার সতর্ক করেছে যে, ইরানের কাছে এতটাই সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুদ আছে যে চাইলে তারা কয়েকটি পরমাণু বোমা বানাতে পারে।
নেতানিয়াহু সোমবার দাবি করেন, ইসরায়েলের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর হামলায় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে ‘অনেক, অনেক দীর্ঘ সময়ের জন্য’ পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে এখনো ইরানের ফোরদো ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রটিতে পৌঁছাতে পারেনি ইসরায়েল, যেটি একটি পাহাড়ের গভীরে নির্মিত।
ফোরদোয় হামলা চালাতে হলে সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব বি-২ স্টেলথ বোমার প্রয়োজন হবে, যেগুলো ‘বানকার-বাস্টার’ বোমা ফেলতে পারে। ৩০ হাজার পাউন্ড (১৪ হাজার কেজি) ওজনের জিবিইউ-৫৭ (GBU-57) ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর তার ওজন ও গতির জোরে গভীর ভূগর্ভস্থ লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে।
ইসরায়েল বলছে, এই ব্যাপক হামলা চালানো জরুরি, যেন ইরান পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণের কাছাকাছি আর পৌঁছাতে না পারে।
দুই দেশের পাল্টাপাল্টি হামলায় ইরানে এখন পর্যন্ত অন্তত ২২৪ জন নিহত হয়েছে। পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রায় ৪০০টি ক্ষেপণাস্ত্র এবং শত শত ড্রোন ইসরায়েলের দিকে নিক্ষেপ করেছে তেহরান। এখন পর্যন্ত ইসরায়েলে ২৪ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।