চরম সংকটে বাগেরহাট ২৫০ শয্যা জেলা হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা


কেবল নামেই ২৫০ শয্যা জেলা হাসপাতাল, বাগেরহাট। ১০০ শয্যার জনবল ও বরাদ্দ দিয়ে জোড়াতালি দিয়ে চালানো হচ্ছে ২৫০ শয্যার এই হাসপাতালের চিকিৎসা কার্যক্রম।
হাসপাতালটিতে চিকিৎসকের ৫৮টি পদের মধ্যে ৩৩টিই খালি রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ অ্যানেস্থেশিয়া বিভাগে ৬ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও একজন মাত্র জুনিয়র কনসালটেন্ট কাজ সারা হচ্ছে। চিকিৎসক না থাকায় হৃদরোগ, চোখ ও নাক-কান-গলা বিভাগে চিকিৎসাসেবা বন্ধ রয়েছে। কিডনি রোগীদের চিকিৎসায় ডায়ালাইসিস কার্যক্রম এখনও চালু হয়নি। এমনকি মুমূর্ষু রোগীর চিকিৎসায় আইসিইউ বিভাগ খোলা হরেও মাত্র এক বছরের ব্যবধানে তা-ও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
জেলা হাসপাতালটি ২৫০ শয্যার হলেও প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৪০০ রোগী ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন এখানে। রোগীদের চাপ বাড়তে থাকায় শয্যা সংকুলান না হওয়ায় শীতের মধ্যেও প্রতিদিন অসংখ্য রোগীকে মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আবার বরাদ্দ না থাকায় ভর্তি হলেও ২৫০-র বেশি রোগীকে খাবার সরবরাহ করা হয় না। ফলে প্রতিদিন অন্তত দেড়শ রোগী হাসপাতালের খাবার পাচ্ছে না।
এত এত রোগীকে চিকিৎসাসেবা দিতে সেবিকারাও রিতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন। একদিকে চিকিৎসকসহ জনবলের সংকট, অন্যদিকে ২৫০ শয্যার জন্য বরাদ্দ এখনও না মেলায় রোগীদের কাঙ্ক্ষিত স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারছে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
সরজমিনে হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, হাসপাতালের নতুন ৭ তলা ও পুরাতন ২ তলা চলছে চিকিৎসা কার্যক্রম ভবনজুড়ে। এর মধ্যে নতুন ভবনের বিভিন্ন ওয়ার্ডের বারান্দা, চলাচলের পথ, সিঁড়ির পাশে, সেবিকাদের কাউন্টারের পাশসহ বিভিন্ন জায়গায় মেঝেতে রোগীদের শয্যা পাতানো হয়েছে। দিনের পর দিন মেঝেতেই চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন রোগীরা। মেঝেতে রোগীদের চাপ এতটাই যে সাধারণ সেবাপ্রত্যাশীদের পাশাপাশি চিকিৎসক ও সেবিকাদেরও চলাচল করতে কষ্ট হয়।
বর্হিবিভাগে চিকিৎসকদের কক্ষের সামনে দেখা যায়, শিশু থেকে শুরু করে নানা বয়সের রোগীদের দীর্ঘ লাইন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তারা লাইনে দাঁড়িয়ে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়ার অপেক্ষা করছেন। শিশুদের কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন স্বজনরা। সেখানে রোগীদের ভিড় এতটাই যে তিল ধারণের ঠাঁই নেই।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য অনুসারে, প্রতিদিন বর্হিবিভাগে ১২শ থেক ১৫শ এবং জরুরি বিভাগে অন্তত ২৫০ জন রোগী চিকিৎসাসেবা নিয়ে থাকেন।
নতুন ভবনের সপ্তম তলায় গিয়ে দেখা যায়, আইসিইউ বিভাগ তালাবদ্ধ।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উপকুলীয় এই জেলার ৯টি উপজেলার মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দিতে ১৯৭০ সালে বাগেরহাট শহরের মুনিগঞ্জ এলাকায় ৫০ শয্যাবিশিষ্ট এই হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু করে সরকার। পরে রোগীদের চাহিদার কথা বিবেচনা করে ১৯৯২ সালের ১৪ মার্চ হাসপাতালটিকে ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। এরপর ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে তা উন্নীত করা হয় ২৫০ শয্যায়। হাসপাতালটি নামে ২৫০ শয্যার হলেও ১০০ শয্যার জনবল ও বরাদ্দ দিয়েই চলছে চিকিৎসা কার্যক্রম।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জেলার ১৭ লক্ষাধিক মানুষের চিকিৎসাসেবার ভরসা বাগেরহাট ২৫০ শয্যা জেলা হাসপাতাল। জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে নানা সমাস্যা নিয়ে প্রতিনিয়ত সেবাপ্রত্যাশীরা এই হাসপাতালে আসছেন। কিন্তু নিদিষ্ট রোগের চিকিৎসক না থাকা, চিকিৎসক সংকট ও প্রয়োজনীয় সব প্যাথলজি পরীক্ষার সুযোগ না থাকায় কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা।
এর ফলে বিভিন্ন পরীক্ষা এবং হাসপাতালে নির্দিষ্ট রোগের চিকিৎসা না পেয়ে রোগীদের অন্যত্র যেতে হচ্ছে। এতে করে নাগরিকের মৌলিক অধিকারের অন্যতম চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন অনেক দরিদ্র রোগী।
হাসপাতাল সূত্র আরও জানায়, সিনিয়র কনসালটেন্টের ১০টি পদের মধ্যে ২টি, জুনিয়র কনসালটেন্টের ১৫টি পদের মধ্যে ৪টি, অ্যানেস্থেশিয়া চিকিৎসকের ৬টি পদের মধ্যে ১টি, মেডিকেল অফিসারের ২৬টি পদের মধ্যে ১৫টি, আবাসিক সার্নজদের ৩টি পদের মধ্যে ২টি ও সেবিকাদের ৯৮টি পদের মধ্যে ৭৩টি পদে লোকবল রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন শ্রেণির কর্মচারী সংকটও রয়েছে হাসপাতালে।
শহরের মুনিগঞ্জ এলাকার মো. জাহিদ জানান, চারদিন ধরে তিনি হাসপাতালে ভর্তি। শয্যা না থাকায় হাসপাতালের মেঝেতে শয্যা পেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এই চারদিনে হাসপাতাল থেকে তাকে কোনো খাবার দেওয়া হয়নি বলে জানান তিনি।
এসকেন্দার আলী সরদার ও জিহাদ তালুকদারসহ আরও কয়েকজন রোগীর সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, কয়েকদিন ধরে তারাও হাসপাতালের মেঝেতে শয্যা পেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। শীতের মধ্যে মেঝেতে থাকতে তাদের কষ্ট হয়, তারপরও চিকিৎসার জন্য বাধ্য হয়ে সেখানেই থাকতে হচ্ছে।
তাদের অভিযোগ, হাসপাতাল থেকে একবারের জন্যও তাদের কোনো ধরনের খাবার দেওয়া হয়নি। চিকিৎসক সংকটের কারণে কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না বলেও জানান তারা।
কয়েকটি শিশু রোগীর স্বজনের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, কয়েকদিন ধরে তারা হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। চিকিৎসা চললেও এখনও তারা সুস্থ হতে পারেনি। চিকিৎসক সংকট আর বরাদ্দ স্বল্পতার প্রভাব চিকিৎসাসেবায় পড়েছে বলে মত তাদের।
হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স নাজমা খানম বলেন, হাসপাতালে প্রতিদিনই রোগীদের চাপ বাড়ছে। শয্যা সংকটের কারণে রোগীদের জন্য মেঝেতে শয্যা পাতানো হচ্ছে। একজন নার্স প্রতিদিন গড়ে ৪০ থেকে ৪৫ জন রোগীকে সেবা দিচ্ছে। প্রয়োজনের তুলনায় নার্সদের সংখ্যা কম থাকায় রোগীদের সেবা দিতে আমরা হিমশিম খাচ্ছি। রোগীরা যে আশা নিয়ে আমাদের কাছে আসে, সেভাবে আমরা তাদের সেবা দিতে পারছি না।
সার্জারি বিভাগের নার্স নিলুফা খানম বলেন, প্রতিদিন রোগী বাড়লেও হাসপাতালের জনবল বাড়ছে না। আমাদের ওয়ার্ডে ৪০ জন রোগীর জন্য খাবার বরদ্দ রয়েছে, কিন্তু প্রতিদিন এখানে গড়ে ৭৫ থেকে ৮০ জন রোগী ভর্তি থাকে। সব রোগীকে খাবার দিতে না পারায় রোগী ও তাদের আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে প্রতিদিন তর্ক করতে হয়। এত সংখ্যক রোগীর সেবা দেওয়াটা সত্যিই খুব কষ্টসাধ্য।
আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. তাপস কুমার সরকার বলেন, ‘হাসপাতালটি জেলার ১৭ লাখ মানুষের চিকিৎসার আশ্রয়স্থল। এখানে শয্যা বৃদ্ধি করা হলেও আনুপাতিক হারে জনবল ও বরাদ্দ বাড়ানো হয়নি, যে কারণে নানা সংকট তৈরি হয়েছে হাসপাতালে। এত অভাব ও সংকটের মধ্যে রোগীদের সন্তুষ্টি নিশ্চিত করে চিকিৎসাসেবা দেওয়া দূরুহ ব্যাপার।’
রোগীদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে সংকট নিরসনের জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষ ও সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এ চিকিৎসক।
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. অসীম কুমার সমদ্দার ইউএনবিকে বলেন, ‘মুলত ১০০ শয্যার জনবল ও বরাদ্দ দিয়ে ২৫০ শয্যার কার্যক্রম চলছে। প্রতিদিন গড়ে ৪০০ রোগী হাসপাতালে ভর্তি থাকে। শয্যা খালি না থাকায় বাধ্য হয়ে মেঝেতে শয্যা পেতে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয়।’
‘২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও চিকিৎসক, জনবল ও বরাদ্ধ না বাড়ানোয় হাসপাতালে ভর্তি সব রোগীকে খাবার সরবারহ করা সম্ভব হয় না।’
জনবলের ঘাটতি নিয়ে ডা. অসীম বলেন, ‘হাসপাতালে চিকিৎসকদের ৫৮টি পদের মধ্যে ৩৩টি পদ শূন্য রয়েছে। সেবিকার সংখ্যাও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। চিকিৎসক না থাকায় হৃদরোগ, চোখ ও নাক-কান-গলা রোগের চিকিৎসা দিতে পারছি না। এ বছরের ১ জানুয়ারি থেকে আইসিইউ বিভাগও বন্ধ রাখা হয়েছে। আর কিডনি ডায়ালাইসিস বিভাগ এখনও চালুই করা সম্ভব হয়নি। সব ধরনের পরীক্ষাও শতভাগ এখানে হয় না।’
তিনি বলেন, ‘হাসপাতাল ২৫০ শয্যায় উন্নীত হওয়ায় রোগীদের প্রত্যাশা বেড়ে গেছে। কিন্তু নানা সংকটের কারণে রোগীদের প্রত্যাশা অনুযায়ী চিকিৎসাসেবা দেওয়া যাচ্ছে না। চাহিদা অনুযায়ী সবকিছু পাওয়া গেলে মানুষের চাহিদা অনুসারে চিকিৎসাসেবা দেওয়া সম্ভব হবে।’